• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

গৌরবের পথচলায় ছাত্রলীগ

প্রকাশিত: ৪ জানুয়ারি ২০২৩  

তোফায়েল আহমেদ   

এ বছর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী তথা হীরক জয়ন্তী উদযাপন করছে। ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে নেতাকর্মীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস। ’ বাঙালির আধুনিককালের ইতিহাস অনুযায়ী কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ—এই চারটি নাম সমার্থক।

বাঙালি জাতিসত্তাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তায় অভিষিক্ত করতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য। নিজ জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে অগ্রণী ভূমিকা পালনের এমন দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক ছাত্ররাজনীতিতে দুর্লভ। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে অভিহিত করেছিলেন অগ্রগামী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। অগ্রসর ভূমিকা পালনে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছাত্রলীগ গৌরবময় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই আন্দোলন-সংগ্রাম সংঘটিত করতে হারিয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতাসংগ্রামে এই মহত্তর আত্মদান একটি ছাত্রসংগঠনের জন্য বিরল গৌরবের।

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের জয়যাত্রা শুরু হয়। জনবিচ্ছিন্ন উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার উদ্যোগ ও শাসক মুসলিম লীগের প্রতারণামূলক অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুসলিম লীগের তরুণ নেতৃত্ব গঠন করে ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠিত করে ছাত্রসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক অধিকারের চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গঠিত হয় ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠার মহতীলগ্নে গঠনমূলক ১০টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে ছাত্রলীগের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি; দেশরক্ষা; স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম; ছাত্রসমাজকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত রাখা; নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে জিহাদ; আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও কৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত চরিত্রের অধিকারী বিপ্লবী কর্মী সৃষ্টি; জাতি ও দেশের কল্যাণে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা; জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকা ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মে সংগ্রাম; প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি আদায়; দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও চোরাকারবারিদের উচ্ছেদ সাধন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন পরিচালনার যে রেওয়াজ প্রচলিত আছে তার ধ্বংসসাধন। উপরোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যর ধারক-বাহক ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রসমাজের অধিকার শুধু নয়, গোটা বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনার মূর্তপ্রতীক হয়ে উঠেছিল।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত আদর্শ-উদ্দেশ্যর প্রতি অবিচল থেকে ছাত্রলীগ অর্জন করে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ। যার প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৩ সালে ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুসলিম ছাত্রলীগের স্থলে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নামকরণ করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের অসাম্প্রদায়িকীকরণের আগেই ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক করা হয়। একই বছর ডাকসু ও বিভিন্ন হল সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ নামে নির্বাচনী জোট গঠিত হয়। ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদ নির্বাচনে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে এবং মুসলিম লীগ সমর্থিত নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য করে। ছাত্রলীগের প্রস্তাবে ও নেতৃত্বে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের’ চেতনাই পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে ১৯৫৪ সালের ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের ভিত্তি তৈরি করে এবং হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে মুসলিম লীগকে বিদায় দেন। নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২২টি আসনেই যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী বিজয়ী হন। যুক্তফ্রন্ট গঠনে এবং যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এরপর ১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ গঠনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৪৮-এ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত কালে সাত বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত চেতনাবলে ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অগ্রগামী বাহিনী ছাত্রলীগের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটান। যে আদর্শ-উদ্দেশ্য ধারণ করে ছাত্রলীগের শুভ সূচনা হয়েছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মধ্য দিয়েই ছাত্রলীগের মতাদর্শিক চেতনার ভিত্তি স্থাপিত হয়।

১৯৫৮ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে বিভিন্ন ফরমান-আদেশবলে রাজনীতি করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, বেত্রাঘাত, অর্থ জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের দণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ফলে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ছাত্রলীগ ‘শিল্প-সাহিত্য সংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সংগঠনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। ১৯৬০ সালের শুরুতে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে, বিশেষ করে শরীফ কমিশন ও হামুদুর রহমান কমিশনের শিক্ষানীতি, রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখতে ছাত্রলীগ সমমনা সংগঠনগুলোকে নিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করে। পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠাকালীন ছাত্রলীগের আদর্শ-উদ্দেশ্যতে ছিল বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ‘প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার’-এর দাবি। ১৯৬৯ সালের মহান গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা তা অর্জন করি। আমাদের অর্জিত সাফল্যের পথ ধরেই ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছিল, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং একাত্তরের মহত্তর মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ পালন করে অগ্রগামী ভূমিকা। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করে গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নেয় বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করে ইতিহাস। সুনির্দিষ্ট আচরণবিধি, নিয়মানুবর্তিতা, সংগঠনের আদর্শ-উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ সৃষ্টি করে অসংখ্য বিপ্লবী ও সংস্কৃতিবান নেতাকর্মী। ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতিবছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে ছাত্রলীগ জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে শামিল হয়ে যে রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা অর্জন করেছিল তা সংরক্ষণ, লালন ও অব্যাহত চর্চা সময়ের দাবি।

আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই, স্মৃতির পাতায় দেখি সেদিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায়ের মুজিব আদর্শ প্রতিষ্ঠার ভ্যানগার্ড। আমি ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম বলে গর্ববোধ করি। সংগঠনের কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগ আমাকে মুজিব আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করার পথই শুধু উন্মুক্ত করে দেয়নি, সেই সঙ্গে দেশসেবার ও দেশ গঠনের মহতী কর্মে আজীবন প্রয়াসী থাকার সুযোগ অবারিত করে দিয়েছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আজ একটি কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, এই সংগঠনের অতীত গৌরবময়, এর বর্তমানকে করে তুলতে হবে আরো তাৎপর্যপূর্ণ, আর ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের গড়ে তুলতে হবে প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে। ছাত্রসমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নির্লোভ ত্যাগী শক্তি বলে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রী মহল তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার নানা ষড়যন্ত্র করেছে। দুইবারের সামরিক শাসন মাদক, অস্ত্র আর অর্থ ঢেলে ছাত্রসমাজের চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে। আমি বিশ্বাস করি, ছাত্রলীগসহ অপরাপর সমমনা প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো এই কুৎসিত ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের রক্ষা করে ছাত্র আন্দোলনের সুমহান ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
[email protected]

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –