• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন কেন জরুরি

প্রকাশিত: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১  

তন্ময় চৌধুরী

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ায় সেদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে তাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমার সরকারের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতার কারণে দীর্ঘ ৪ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

ফলে কক্সবাজার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় ও রোহিঙ্গা কর্তৃক সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, যা শান্তিকামী স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই খুব পীড়াদায়ক। ইউনিসেফের তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইতোমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

রোহিঙ্গা আসার পর থেকে নির্বিচারে বন ও পাহাড় কাটায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়াসহ জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যের পরিবর্তনের কারণে কক্সবাজারে পানির স্তর ইতোমধ্যে অনেক নিচে নেমে গেছে। বন্য হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই তারা লোকালয়ে চলে আসে এবং বসবাসরতদের জন্য জীবননাশের হুমকি তৈরি করে।

কক্সবাজার জেলায় মোট ১,১৫৬ ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী থাকলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপস্থিতিতে তাদের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেগুলো ঝুঁকিতে পড়ার পাশাপাশি বিলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গার উদ্বৃত্ত আবর্জনা কৃষিজমিতে স্তূপ করায় তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে পরিকল্পিত ও বসবাসযোগ্য আবাসস্থল হিসাবে ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তরিত হলে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের জনজীবন ও জীববৈচিত্র্য দুটোরই ব্যবস্থাপনা করা বাংলাদেশের পক্ষে সহজ হবে।

পরিবেশগত বিপর্যয় ছাড়াও স্থানীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতির দিকে আলোকপাত করলে যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য সামনে আসে তাতে প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা একসঙ্গে থাকায় ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

নিজেদের মধ্যেই হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ১৯ হাজার শান্তিকামী রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় উন্নততর ও সুব্যবস্থাসম্পন্ন ভাসানচরে গিয়ে নিরাপদ জীবনযাপন করছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত ৪ বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন অপরাধের কারণে মামলা ও আসামির সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

অনেক রোহিঙ্গা তাদের গোত্রীয় অপরাধীদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে নিরাপদ জীবনযাপনের আশায় ভাসানচরে স্থানান্তরিত হতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও কিছু আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন ও সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর প্রলোভন, হুমকি এবং ভাসানচর সম্পর্কে গুজব ছড়ানোর কারণে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তরিত হলে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বেশ কিছুটা খোলামেলা পরিবেশ তৈরি হবে। ফলে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোকে পর্যবেক্ষণ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে। ভাসানচর সমতল ভূমি হওয়ায় রোহিঙ্গা কর্তৃক বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলনামূলক কম হবে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন। তাই স্থানীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের উদ্যোগটি বাংলাদেশ সরকারের একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

কক্সবাজারে সমতল ভূমি অপ্রতুল হওয়ায় পাহাড়বেষ্টিত বনভূমি ধ্বংস করে বানানো ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা অবস্থান করার ফলে প্রায়ই ঘটছে বিভিন্ন দুর্ঘটনা। প্রতি বছর বর্ষাকালে ভূমিধসের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে উপত্যকা এলাকায় বসবাসরত হাজারও বাস্তুচ্যুত পরিবার। কক্সবাজারে গত জুলাইয়ে ভূমিধসে রোহিঙ্গাসহ ২৩ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং অনেকে আহত হয়।

অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা দেখা দিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা বিভিন্ন রোগ তৈরির উৎস হিসাবে কাজ করে। জুলাইয়ে বন্যার কারণে ৪ শিশুসহ ১১ রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করে এবং ৪ হাজার ঘর পানিতে তলিয়ে যায়, যার ফলে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা আবাসহীন হয়ে পড়ে। মাদক ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্র“প থাকায় এক গ্র“প আরেক গ্র“পের নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়ে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

ক্যাম্পের অস্থায়ী ঘরগুলো লাগোয়া এবং দাহ্য পদার্থবিশিষ্ট হওয়ায় আগুন দ্রুত এক ঘর থেকে অন্য ঘরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভাসানচরের ঘরগুলো ইটের তৈরি এবং পরিকল্পিত হওয়ায় সে ধরনের ঝুঁকি অনেকটাই কম। তাই জীবনের ঝুঁকি কমাতে এবং উন্নততর ও নিরাপদ পরিবেশে জীবন নির্বাহে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়া উচিত।

অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ভাসানচর থেকে পালিয়ে থাকে বলে শোনা যাচ্ছে, যাদের অধিকাংশই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত বা এর শিকার। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর ত্রাণ কার্যক্রম দ্রুত শুরু হলে ভাসানচরের প্রতি রোহিঙ্গাদের আগ্রহ আরও বাড়বে বলে মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন।

বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন শেষে ইইউ, ওআইসি ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা ও জীবনযাত্রার সার্বিক অবস্থা বিষয়ে খুবই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন এবং জাতিসংঘ ভাসানচরের সার্বিক কার্যক্রমে যুক্ত হবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে।

ভাসানচর একটি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা হওয়ার যেসব আপত্তি শুরুতে ছিল তা সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ ও ‘ইয়াস’-পরবর্তী টেকসই ও সহনশীল ভাসানচরের চিত্র দ্বারা খণ্ডিত হয়। তাই শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরকে ‘শান্তির চর’ বললেও ভুল হবে না। পরিকল্পিত ও প্রশস্ত আবাসন, স্কুল, মাঠ, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সাইক্লোন শেল্টারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে ভাসানচরে।

রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে ভাসানচরে বর্তমানে ২২টি এনজিও সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলো কার্যক্রম শুরু করলে ১৬ হাজার একরের ভাসানচরে আরও কর্মসংস্থানমূলক নতুন নতুন প্রকল্প (যেমন- মৎস্য আরোহণ, গবাদি-পশুপালন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কারখানা স্থাপন ইত্যাদি) বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে, যা কক্সবাজারের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পগুলোতে অসম্ভব।

ভাসানচরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ‘চট্টগ্রাম-হাতিয়া হতে ভাসানচরের সঙ্গে নৌযোগাযোগ উন্নয়ন’ নামে একটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এতে ভাসানচর ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় পণ্য আনা-নেওয়া আরও সহজ হবে।

প্রায় ৩১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এমন মহৎ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আরও বেসরকারি সংগঠন দ্রুত সম্পৃক্ত হলে মিয়ানমারে গণহত্যা ও বীভৎস অবস্থার শিকার এই হতাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘পোস্ট ট্রমাটিক গ্রোথ ও রেজিলিয়েন্স’ গঠন সহজতর হবে।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের মূল ও একমাত্র উপায় হলো রোহিঙ্গাদের তাদের আদিনিবাস রাখাইনে প্রত্যাবাসন করা। কিন্তু ১ ফেব্র“য়ারি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক অভ্যুত্থান তা অনেকটা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এমন অনিশ্চিত ও দীর্ঘ সময়ের জন্য ১১ লাখ রোহিঙ্গার জনাকীর্ণ অবস্থায় কক্সবাজারের পাহাড়ঘেঁষা ভূমিতে অবস্থান তাদের জীবনের ওপর হুমকি তৈরি করবে।

তাই এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তরিত হলে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল কমে সদ্ভাব তৈরি হবে এবং বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর পক্ষে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা করা সহজ হবে বলে প্রতীয়মান।

লেখকঃ লেখক ও গবেষক।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –