• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

অটিজম, সায়মা ওয়াজেদ এবং বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২ এপ্রিল ২০২১  

মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া   

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের নতুন ঢেউয়ের মধ্যে আজ পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। করোনাভাইরাসের চরম আতঙ্কে বিশ্ববাসী যখন এক প্রত্যাশিত ও অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে জীবন-জীবিকার অবিরাম যুদ্ধে পরিশ্রান্ত; একই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, বিশেষত অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও এই যুদ্ধের কবলে পড়ে এক দীর্ঘমেয়াদি অসমতা, বৈষম্য আর অন্যায্যতার মুখোমুখি। কভিড-১৯ মহামারি সমাজে পিছিয়ে থাকা, পিছিয়ে রাখা কিংবা পিছিয়ে পড়া মানুষের সহজাত জীবনধারায় এক সুস্পষ্ট অসাম্যতার সীমারেখা টেনে দিচ্ছে; যা সমহারে সম্পদ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার, আইনের অধীনে সুরক্ষা, অর্থনৈতিক সুরক্ষা, শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির ফারাক আরো দৃশ্যমান করছে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কভিড-পূর্ব ছিল তা ক্রমহ্রাসমান। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদিও দীর্ঘকাল ধরে এই বহুমাত্রিক অসমতার মুখোমুখি, তথাপি তাদের অসমতা উত্তরণে বিশ্বব্যাপী যে বা যাঁরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্ব পরিসরে সবচেয়ে সমাদৃত একটি নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। কিন্তু বিদ্যমান মহামারি এই অসমতাকে কিছুটা উসকে দিচ্ছে। যার পরিণাম হবে অটিজম ব্যক্তিদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃত বৈষম্য নিরসন অনুশীলন আরো দীর্ঘায়িত হওয়া। অটিজম ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের এই বৈরী বলয়ে চলার অদম্য স্পৃহা জাগ্রতকরণে বিশ্বব্যাপী একজন সায়মা ওয়াজেদ যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা যেন এই কভিড থামাতে না পারে এ জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশ তথা জাতিসংঘ কর্তৃক একটি সৃজনশীল অথচ বাস্তবমুখী সমন্বিত কার্যধারা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ। যদিও উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বনেতাদের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘে বিশ্বনেতারা টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) লক্ষ্য ৮-এ উল্লিখিত ‘ডিসেন্ট ওয়ার্ক এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সবার জন্য পূর্ণ এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদের (ইউএনসিআরপিডি) ২ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ্য রয়েছে যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্যের সঙ্গে সমান ভিত্তিতে কাজ করার অধিকার এবং একটি কর্মপরিবেশ যা উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্ত এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশযোগ্য।’ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এ সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। সুতরাং এ দায়বদ্ধতা শুধু একজন সায়মা ওয়াজেদের নয়, এ দায়বদ্ধতা বিশ্বের প্রতিটি অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের।

‘অটিজম’ শব্দটির সঙ্গে আজ থেকে ১০ বছর আগেও আমরা তেমনভাবে পরিচিত ছিলাম না। অনেকেই অটিস্টিক শিশু দেখলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত। এ ধরনের শিশুদের নিয়ে সমাজে কিছু ভ্রান্ত ধারণাও বিরাজিত ছিল। যেমন—অনেকে মনে করতেন বা এখনো কেউ মনে করেন, অটিজম শনাক্তকরণে মেডিক্যাল টেস্ট প্রয়োজন কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। শুধু চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা শিশুর আচরণ মূল্যায়ন করেই শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত কি না তা নির্ধারণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিশুর চোখে চোখ না রাখা, নাম ধরে ডাকলে কোনো প্রতিক্রিয়া না করা, দুলতে থাকা এবং খেলনা দিয়ে অর্থহীনভাবে খেলা করা, বারবার একই কথা বলা, একই কাজ বারবার করার মতো আচরণগত বিষয়গুলো হতে পারে মূলত বিবেচ্য বিষয়। আবার কেউ মনে করেন, উন্নত চিকিৎসা পেলে অটিজম একেবারে সেরে যাবে; কিন্তু বাস্তবে অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, বিহেভিয়র মডিফিকেশন টেকনিকসহ বিভিন্ন নিবিড় পরিচর্যা এবং কিছু অগ্রিম পদক্ষেপে অটিজম আক্রান্ত শিশুর অনেক উন্নতি করা সম্ভব। কোনো কোনো অভিভাবক আবার মনে করেন, অটিজম সমস্যা সাময়িক, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সেরে যাবে। তাই শিশুটির জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। বাস্তবতা হলো, এ শিশুদের সমস্যা কখনোই পুরোপুরি দূর হয় না। তবে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে এর মাত্রা কমিয়ে আনা যায়। স্বল্প মাত্রায় অটিজম, যেমন—এসপারজার সিনড্রোম অথবা হাই ফাংশনিং অটিজমের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশু পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। তবে উচ্চমাত্রায় অটিজমের ক্ষেত্রে পরিণত বয়সেও স্বনির্ভর দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্ভব না-ও হতে পারে। মূলত অটিজম বা অটিস্টিক একটি মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা। যারা এ সমস্যায় ভোগে তাদের মূলত প্রতিবন্ধিকতা তৈরি হয় সামাজিক কার্যকলাপে। জন্মের দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই এ সমস্যা বুঝতে পারা যায়। বাংলাদেশের প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৭ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত। দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) গবেষণায় দেখা গেছে, আট বছর বয়সী প্রতি ৬৮ জন শিশুর মধ্যে একজন এএসডি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন (৪২ জন ছেলেশিশুর এবং ১৮৯ মেয়েশিশুর মধ্যে একজন করে)। কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর চেয়ে শ্বেতাঙ্গ শিশুদের মধ্যে এএসডি লক্ষণ ৩০ শতাংশ বেশি। অটিজম আক্রান্ত সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশেষত বাংলাদেশে অটিজম-সংক্রান্ত ধারণা দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। বর্তমানে অটিজম নিয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্বজুড়েই নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সবার মধ্যে বেড়েছে সচেতনতা। বাংলাদেশেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় অটিজম আক্রান্তরা নানাভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। ১৯৯৭ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক ও ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য এবং একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করেন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে অটিস্টিক শিশুদের অধিকার ও শিশুদের অটিজম-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ করে আসছেন। সায়মা ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর জাতিসংঘের অটিজম সচেতনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন। তিনি জাতিসংঘ আয়োজিত ‘অ্যাড্রেসিং দ্য সোসিওইকোনমিক নিডস অব ইনডিভিজুয়ালস, ফ্যামিলিস অ্যান্ড সোসাইটিজ অ্যাফেকটেড বাই অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডারস, ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ডিজঅ্যাবিলিটিজ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পুনম ক্ষেত্রপাল সিংয়ের উদ্যোগে এ অঞ্চলের ১১টি দেশের জন্য অটিজম-সংক্রান্ত ব্যক্তিদের কল্যাণে নিরবচ্ছিন্ন ও উদ্ভাবনী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে অটিজমবিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মনোনীত হন। এ ছাড়া সায়মা ওয়াজেদ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের একজন মনোনীত (সিভিএফ) ‘থিমেটিক দূত’। এরই মধ্যে সায়মা বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় নিজের স্থান করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে সায়মা ওয়াজেদ পরিচালিত ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এক ইতিবাচক পরিবর্তনের বাতিঘর। তাই অটিজম, সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল এবং বাংলাদেশ এক সূত্রে গাঁথা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন, মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন।
[email protected]

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –