• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

আউটসোর্সিংয়ে প্রতিষ্ঠিত চিরিরবন্দরের বেলাল

প্রকাশিত: ৭ নভেম্বর ২০২০  

বাংলাদেশের যে তরুণেরা দেশে বসেই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন, দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে বেলাল সরকার তাদের একজন। তবে অন্যদের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো রাজধানী কিংবা জেলা শহরে নয়, তিনি গ্রামে থেকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন। এছাড়া তিনি একা স্বাবলম্বী হননি, কাজের ব্যবস্থা করেছেন নিজের এলাকার তরুণ-তরুণীদের।

চিরিরবন্দরে বসে আউটসের্সিংয়ের কাজ করে সাফল্য ও ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন বেলাল। স্থানীয়ভাবে তিনি ইন্টারনেট বেলাল নামে পরিচিত। উপজেলা শহরের শেষ মাথায় শিমুলতলী রেলগেট এলাকার প্রবেশমুখে ঢুকলেই চোখে পড়বে তার পাঁচতলা বাড়িটি। বেলালের প্রতিষ্ঠানের নাম ক্লিপিং বিডি। এতে কাজ করেন ৫০ জন। শুধু রেলগেট এলাকাই নয়, পুরো উপজেলায় এমনকি আশপাশের এলাকায়ও বেলাল এখন পরিচিত মুখ।

বেলাল জানান, দিনাজপুর শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে চিরিরবন্দরে পৌঁছে গেছে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। ফলে বেলাল তার আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানকে উপজেলার শহরতলীতে নিজের বাড়িতে নিতে পেরেছেন। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের ফটোশপ, ই-বুক ডিজাইন, গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া, ভিডিও অ্যানিমেশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন অ্যান্ড ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো কাজ করে বেলালের প্রতিষ্ঠান মাসে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আনে।

তিনি বলেন- বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগের প্রচেষ্টায় তরুণ-তরুণীদের আউটসোর্সিং-এ এখন আগ্রহ বাড়ছে। বেকারত্ব দূর করে নিজেরা হচ্ছেন স্বাবলম্বী। বেকারত্ব কোনো সমস্যা নয়, কাজের প্রতি অনাগ্রহটাই মূল সমস্যা।

তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের হিসাব মতে, দেশে প্রায় পাঁচ লাখ তরুণ আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন। তারা বছরে ১০ কোটি ডলার আয় করেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৫০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের (ওআইআই) হিসাব মতে, অনলাইনে কর্মঘণ্টা বিক্রিতে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। এ তালিকায় ভারত ও পাকিস্থান শীর্ষে রয়েছে।

বেলাল জানান, ২০০৩ সালে ঢাকায় আইআইএসটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিষয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। পড়াশোনার টাকা জোগাতে না পেরে উইন উইন ইনফোসিস নামে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে খন্ডকালীন চাকরি নেন তিনি। বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু ওই কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার সময়ও আউটসোর্সিং বিষয়ে তেমন কিছু জানতেন না তিনি। যখন জানতে পারেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের বাইরের কাজ করে ভালো আয় করা যায়। নিজে কিছু করার ও কাজ শেখার আগ্রহটা তখন থেকেই। গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়ার্ড প্রেসসহ বেশ কিছু বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। ফলে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে বেতন দাঁড়ায় ২৫ হাজার টাকা। ২০০৬ সালে বিয়ে করে উত্তরায় বাসা ভাড়া নেন বেলাল। অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরে নিজেই বাড়তি কাজ করতে শুরু করেন। স্ত্রী শামীমা নাসরীনকেও কাজ শিখিয়ে দেন। পাশাপাশি নিজের গ্রাম থেকে পাঁচজন তরুণকে ঢাকায় আনেন কাজ শেখানোর জন্য। একদিন পেয়ে যান ১৪ হাজার ডলারের একটি কাজ।

বেলাল বলেন, ‘একসময় বুঝতে পারি, চাকরি আর নিজের কাজ দুটি একসঙ্গে হবে না। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ক্লিপিং বিডি নামে নিজের প্রতিষ্ঠান খুলি।’

পরে রংপুরে উচ্চগতির ইন্টারনেটের খবর পেয়ে ২০১০ সালে সেখানেই চলে যান বেলাল। একটি ভাড়া বাড়িতে ৪০ জন তরুণকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। তবে ইচ্ছা ছিল নিজের গ্রামে ফেরা। অপেক্ষায় ছিলেন সেখানে কবে উচ্চগতির ইন্টারনেট যায়। তিন বছরের মধ্যে মাঝাপাড়াতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গেল। বেলালও গ্রামে ফিরলেন। ৪০টি কম্পিউটার নিয়ে নিজেদের বাড়ির নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় কাজ শুরু করল ক্লিপিং বিডি।

বেলাল বলেন, ‘এলাকার মানুষ প্রথমে আমাকে সহজভাবে নিতে পারেননি। ৪০ শতক জমির ওপর একাধিক বহুতল ভবন ও মার্কেট গড়ে তোলা, এতগুলো লোক এখানে কী কাজ করে, এসব নিয়ে নানা আলোচনা চলত।’

কিন্তু একসময় কাজের পরিধি বাড়ায় এলাকার ৭৫ জন তরুণ-তরুণীকে কাজ শেখানোর উদ্যোগ নেন বেলাল। পরে তারা বেলালের প্রতিষ্ঠানেই কাজ শুরু করেন।

তিনি জানন, তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রতি মাসে তরুণেরা পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা আয় করতে শুরু করেন। এরপরই এলাকার মানুষের নেতিবাচক চিন্তা দূর হয়।

বেলাল বলেন, ‘দক্ষতা, পরিশ্রম ও ধৈর্য না থাকলে আউটসোর্সিংয়ে ভালো করা কঠিন। অনেক সময় নিজের ভুলগুলো ধরা যায় না। সে জন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা জরুরি। তাছাড়া কাজের মান খারাপ হলে দেশের ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি বিদেশি গ্রাহকদের আস্থা কমে যাবে। আগামী দিনে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং খাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।’

এছাড়াও বেলাল স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে প্রশংসিত ও সম্মানিত হয়েছেন। দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহে উপজেলা পর্যায়ে, জেলা প্রশাসন থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও সামিটে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছেন বেলাল। ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ প্ল্যাটফর্ম থেকে পেয়েছেন ‘উদ্যোক্তা সম্মাননা’। তিনি অনেকের কাছেই উদাহরণ।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –