• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ভাসানী থেকে হাসিনা যুগ

প্রকাশিত: ২৩ জুন ২০২১  

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী   

পাকিস্তান হওয়ার আগেই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে মুসলিম লীগে ভাঙন ধরেছিল। তখন প্রাদেশিক বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ। ঢাকার উর্দুভাষী নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন মুসলিম লীগের ডানপন্থী অংশের নেতা। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম ছিলেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং প্রগতিশীল মনের লোক। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগে এবং মুসলিম ছাত্রলীগে প্রগতিশীল অংশ তৈরি হয়। এই প্রগতিশীল অংশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দেয়। কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক ড. গোবিন্দ অধিকারী ‘পাকিস্তান ও জাতীয় ঐক্য’ গ্রন্থে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কেন দরকার তা বিশ্লেষণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, নুরুর রহমান, নুরুদ্দিন, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ প্রগতিশীল ছাত্রনেতারা ছাত্রলীগের প্রগতিশীল অংশে ছিলেন। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশে শহীদ সোহরাওয়ার্দী অন্যতম ছিলেন। আবুল হাশেম কংগ্রেসের শরৎ বসুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্ত বাংলা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তা ব্যর্থ হয়। এভাবে মুসলিম লীগের ভেতরে একটি প্রগতিশীল অংশ তৈরি হয়। দেশভাগের সময় জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীর চক্রান্তে খাজা নাজিমুদ্দীন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা হন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হন। ঢাকায় রাজধানী হয় এবং বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঢাকায় চলে আসে।

পূর্ব পাকিস্তানে নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভা বাঙালির অধিকারবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ছাত্রলীগের প্রগতিশীল অংশ শেখ মুজিব, আনোয়ার হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে একটি বিরোধী দল গঠনের উদ্যোগ নেয়। তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির গঠন করেন। তখন অলি আহাদ এবং আরো অনেক প্রগতিশীল যুবনেতা যোগদান করেন। এই সময় আসাম থেকে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশে আসেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সরকারবিরোধী নেতাদের সভা হয়। তাতে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। তিনি মুসলিম লীগে ছিলেন কিন্তু বাংলাদেশে এসে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। এই সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীও করাচিতে ছিলেন। তিনি সেখানে জিন্নাহ মুসলিম লীগ নামে একটি দল গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের তরুণ নেতা করাচিতে যান এবং শহীদ সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করেন। শহীদ সাহেব তাঁর দল ভেঙে দেন এবং আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তাঁকে করা হয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। আজকের ৭২ বছরের সংগঠন আওয়ামী লীগের যাত্রা এভাবেই শুরু। এই দীর্ঘ ৭২ বছরেও বার্ধক্য তাঁকে স্পর্শ করেনি। কারণ প্রতি যুগেই আওয়ামী লীগ নতুন করে তারুণ্য গ্রহণ করেছে এবং জাতিকে নতুন নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের প্রথম যুগটি হচ্ছে ভাসানী যুগ। এই যুগের প্রথম দিকে দলটি ছিল সাম্প্রদায়িক। নাম মুসলিম আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব তখন ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। তারপর তিনি হন যুবনেতা। নেতা হওয়ার পরেই তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন এবং পরে সাধারণ সম্পাদক হন। ভাসানী-মুজিব নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতার খোলস ত্যাগ করে, হয় অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ। পূর্ব পাকিস্তানে তখন মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। সামন্তবাদে ভাঙন ধরেছে। দেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা উন্নত হয়েছে। ১৯৫২ সালেই তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করে। বহু তরুণ শহীদ হন। আওয়ামী লীগ ভাষার অধিকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন হয় এবং হক-ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। মাঝখানে আওয়ামী লীগের শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিছুদিনের জন্য কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকেও অপসারণ করা হয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয় এবং জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেন। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয় এবং বহু নেতা কারাবন্দি হন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে এক বিশাল দল। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ এবং অনেক বড় বড় কমিউনিস্ট নেতা আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাজনীতিতে তাঁদের সমর্থন ছিল মওলানা ভাসানীর দিকে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ডানপন্থী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ভাসানীর মতবিরোধ বড় হয়ে ওঠে। ওই সালেই কাগমারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। মওলানা ভাসানী একদল প্রগতিশীল নেতাসহ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। আমার ধারণা, এই সময় পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে দল ভাগ করা একটা বড় ভুল হয়েছিল। তাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জাতীয় ঐক্য ভেঙে যায়। এতে করে আইয়ুব খানের পক্ষে সামরিক শাসন প্রবর্তন সহজ হয়েছিল। কাগমারীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভাসানী যুগের অবসান হয়। শুরু হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যুগ। এই সময় আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ প্রগতিশীল নেতা ভাসানীর নবগঠিত দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু শেখ মুজিব দল ত্যাগ করেননি। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি তিনি ভাসানীর প্রগতিশীল নীতি পরিত্যাগ করেছেন? এর সহজ উত্তর, তিনি তা করেননি। পররাষ্ট্রনীতির মতো একটি প্রশ্নে দল ভাগ করা তিনি সঠিক মনে করেননি। তিনি জানতেন কংগ্রেস থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসুর মতো নেতাদের দল ত্যাগ করা সম্ভবত ঠিক হয়নি। তাতে কংগ্রেস নেতৃত্ব ডানপন্থীরা দখল করার সুযোগ পেয়েছিল। নেহরু থাকায় কংগ্রেস ডান দিকে হেলে পড়েনি। শেখ মুজিব সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগে ডানপন্থীদের মাথা তুলতে দেননি। তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে নানা ব্যাপারে মতের মিল দেখেননি তথাপি আপস করে চলেছেন। ১৯৫৫ সালে দলকে অসাম্প্রদায়িক করার ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত ছিল না। কিন্তু ভাসানী ও মুজিবের চাপে তিনি তা মেনে নেন। তারপর যুক্ত নির্বাচনের প্রশ্নেও শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্ত নির্বাচনের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু ভাসানী-মুজিবের চাপে তিনি তা-ও মেনে নিতে বাধ্য হন। ভাসানী চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ ডান দিকে হেলবে এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তত দিনে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে স্বাধিকার চেতনা প্রবল হয়ে উঠেছে। এবং তারা নেতা হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন শেখ মুজিবকে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইয়ুবের সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে বিরোধী দলের সব নেতাকে নিয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। তাঁর অকাল মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দীন এই নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনিও মারা যান। আইয়ুবের আমলেই রাজনৈতিক দলগুলো পুনরুজ্জীবনের অধিকার পায়। সব প্রবীণ নেতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন এবং দলের নেতৃত্বও গ্রহণ করেন। প্রবীণ নেতারা দূরে সরে যান। বাঙালির মুক্তি সনদ হিসেবে তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফা ঘোষণা করেন তখন বাকি প্রবীণ নেতারা দল থেকে চলে যান। তাঁরা আওয়ামী লীগ নামে পাল্টা দল গঠন করে শেখ মুজিবকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। তাঁদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেখ মুজিব জেলে বসে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করেন এবং সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদকে করেন সাধারণ সম্পাদক। পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ নেতাকর্মীরা তাঁকে সমর্থন দেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের শুরু হয় মুজিব নেতৃত্বের যুগ। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ডানপন্থী নীতির ফলে আওয়ামী লীগ কিছুটা সাধারণ মানুষের সমর্থন হারিয়েছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগে দলে দলে তরুণ নেতা ও কর্মীরা আসেন। দল একটি মধ্য বামপন্থী দল হয়ে দাঁড়ায় এবং দলের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র যুক্ত হয়।

আওয়ামী লীগে মুজিব যুগই হচ্ছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল যুগ। মধ্যপ্রাচ্যে জামাল নাসের আরব জাতীয়তাবাদ প্রচারের কিছু আগে বাংলাদেশে শেখ মুজিব অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন। তিনি ঘোষণা করেন পূর্ব পাকিস্তান নয়, এই ভূখণ্ডের নাম বাংলাদেশ। আমরা হাজার বছর ধরে বাঙালি। এখনো আমাদের পরিচয় হবে বাঙালি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদ যতটা ঢেউ তুলে ছিল তার চেয়ে বড় ঢেউ তোলে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালির যে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তার মিল দেখা যায় মিসরের কয়েক হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সভ্যতার সঙ্গে। নাসের সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিলেন। বাংলাদেশে সেই ঐতিহ্য ধারণ করেন শেখ মুজিব এবং সেই জাতীয়তার বাহক হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। শেরেবাংলা ফজলুল হকও মারা যান ষাটের দশকের গোড়াতেই। তাঁর কৃষক-প্রজা ভিত্তিক রাজনীতির আদর্শ শেখ মুজিব গ্রহণ করেছিলেন। গ্রহণ করেছিলেন দেশবন্ধুর স্বাদেশিকতা এবং সুভাষ চন্দ্রের সংগ্রামী আদর্শ। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবন গড়ার প্রাথমিক গুরু। সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খোলস তিনি ত্যাগ করেছিলেন দেশ ভাগের পরই। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় তাতে দেখা যায় ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি। তারা পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তান রক্ষায় কোনো প্রকার চেষ্টা করেনি। ফলে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের দুই অংশ ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে এক থাকতে পারে না। তাদের ভাষা, খাদ্য, পরিধানের কাপড়, জীবনযাত্রা সবই ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবেও উন্নত হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে। যখনই কোনো বাঙালি নেতা এই বৈষম্য দূর করতে চেয়েছেন, তাঁদের ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। এমনকি রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শেখ মুজিব এই বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার চান। তাঁকে দমন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বহু চেষ্টা করে। কিন্তু জনগণের বিপুল সমর্থন তাঁর পেছনে থাকায় তাঁকে দমন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়া হয়। পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে প্রধান আসামি করা হয়। বলা হয় তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের ফলে শেখ মুজিব কারামুক্ত হন। আইয়ুব খান তাঁকে রাজনৈতিক আলোচনার জন্য গোলটেবিল বৈঠকে ডাকেন। সেখানেও ছয় দফার প্রশ্নে তিনি অটল থাকেন। ছয় দফায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে একটি প্যারামিলিশিয়া গঠনের অধিকার দিতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে।

আইয়ুব এই ছয় দফা মানতে অস্বীকার করেন। বৈঠক ভেঙে যায়। শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন। জনগণ তাঁকে বঙ্গবন্ধু আখ্যা দেয়। সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। আইয়ুবের পর জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসেন এবং পাকিস্তানের উভয় অংশে একটি সাধারণ নির্বাচন দেন। আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি জয়ী হয়। সামরিক জান্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ডাকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। তাতে সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিবেশী ভারতে চলে যান এবং তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করেন। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি হন জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধু। তাঁর নামে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয় এবং ভারতের সাহায্য-সহায়তায় ৯ মাসেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয় স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকার। শেখ মুজিবের নেতৃত্ব তখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। নেহরু, নাসের, টিটো, ইন্দিরা, হো চি মিনের সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বের তুলনা হয়। এই সময় দিল্লির একটি পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে ও সংগ্রামে নিখিল ভারত কংগ্রেসকে ছাড়িয়ে গেছে। আওয়ামী লীগকে এখন অনায়াসে একটি বাম ঘেঁষা গণতান্ত্রিক দল হিসাবে গণ্য করা যায়। এই দলের নেতা শেখ মুজিবের কৃতিত্ব অনন্য। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি জাতি পুনর্গঠন করেছে। একটি ভূখণ্ডকে স্বাধীন করেছে। তার জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করেছে এবং বিশ্বের মানচিত্রে এই দেশটি একটি গৌরবের স্থান করে নিয়েছে।’

মুজিব যুগের আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক সোশ্যালিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। শুধু পশ্চিম ইউরোপীয় সোশ্যালিস্ট নেতারা নন, পূর্ব ইউরোপের গোঁড়া কমিউনিস্ট দেশগুলোও বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে। তখনকার সুপার পাওয়ারের একটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সাহায্যদাতা এবং এখন স্বাধীন দেশটির মিত্র। বঙ্গবন্ধু বিশ্ব শান্তি পরিষদ থেকে আন্তর্জাতিক জুলিও কুরি শান্তি পদক পান। তাঁকে আখ্যা দেওয়া হয় বিশ্ববন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিরাট রূপান্তর ঘটে। আরো কয়েকটি বাম দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ নাম নেয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল। বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সফল হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক বিরাট জয়যাত্রা শুরু হতো। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৭৫ সালে তিনি শাহাদাতবরণ করেন।

মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু আদর্শের মৃত্যু হয় না। সেটা আরো বেশি করে প্রমাণ হলো আওয়ামী লীগের বেলায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস আওয়ামী লীগের ইতিহাস। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে সব সময় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করা হলেও তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন বিদেশে ছিলেন, তাঁরা বেঁচে যান। শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে এসে অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। আশির দশকের গোড়ায়। শুরু হয় আওয়ামী লীগের হাসিনা যুগ। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে স্বৈরাচারী শাসকরা প্রায় ২১ বছর ক্ষমতা দখল করে রাখেন, তাঁরা রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি বদল করে পচনশীল পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যান। দেশে দুর্নীতির পাহাড় তৈরি করে যান। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে একদিকে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমন এবং অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতার অভ্যুত্থান রোখার কাজে ব্রতী হন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। তাঁর আমলে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। একটি কৃষিভিত্তিক দেশকে তিনি শিল্পোন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যান। হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের এই সময়টা বাংলাদেশের উন্নতির স্বর্ণযুগ। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিশাল আয়তনে অনেক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি এখন আশ্রয় নিয়েছে এবং দলটিকে বিপথে চালনার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনা দলের ভেতরে কঠোর হাতে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন। যার ফলে আওয়ামী লীগ এখনো ভারতের কংগ্রেসের পরিণতি বরণ করেনি। আওয়ামী লীগের হাসিনা যুগ নিয়ে একদিন গবেষকরা গবেষণা করবেন, যেমন তাঁরা এখনো গবেষণা করেন শায়েস্তা খাঁর আমল নিয়ে। শেখ হাসিনার আমল ভালো-মন্দে মিশিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় যতটা উন্নত করেছে, আগে তা কখনো হয়নি। এই গৌরব আওয়ামী লীগেরও। আওয়ামী লীগ তার ৭২ বছর বয়সের মধ্যে জাতি গঠন করেছে, স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন করেছে—এর তুলনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। আর কোনো রাজনৈতিক দল এই গৌরব অর্জন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ আজ ৭৩ বছরে পা দিল। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে অনেক তরুণ নেতা আওয়ামী লীগে এসেছেন। শেখ হাসিনাকে ঘিরে যে তরুণ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে তাতে মনে হয় আওয়ামী লীগ শিগগিরই বৃদ্ধ হবে না। সব ভুলত্রুটি কাটিয়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে টিকে থাকবে। কারণ ভাসানী যুগ, সোহরাওয়ার্দী যুগ, মুজিব যুগ পেরিয়ে আজকের হাসিনা যুগে যে আওয়ামী লীগ পা দিয়েছে তার মৃত্যু আছে বলে আমি মনে করি না। দলটির ৭৩তম জন্মদিবসে অভিনন্দন জানাই। জয়তু আওয়ামী লীগ। জয়তু শেখ হাসিনা।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –