• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

সংসারের অভাব ঘোচেনি ঠাকুরগাঁওয়ের বীরাঙ্গনা টেপরি বেওয়ার

প্রকাশিত: ১৮ অক্টোবর ২০২০  

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলা বলিদ্বারা গ্রামের বীরঙ্গনা টেপরি বেওয়া (৬৫)। বাড়িতে ঢুকতেই মুখে মৃদু হাসি দিয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন। এরপরে বসতে দিলেন চেয়ারে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কাছে এসে বললেন, কী জানতে চান বলেন? 

১৮ অক্টোবর রবিবার সকালে একান্ত সাক্ষাৎকারে টেপরি বেওয়া তার নিজ বাড়িতে আলাপকালে জানান, ১৯৭১ সাল দেশে তখন ভয়াল স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমার বয়স তখন ১৬-১৭ এর মতো হবে। প্রতিদিন বাবা-ভাইয়ের সাথে ভয়ে ভয়ে কাটতো দিন। প্রতিদিনই মনে হতো এই বুঝি পাঞ্জাবিরা এসে তাদের মেরে ফেলবে। এপ্রিলের শেষ দিকে টেপরির গ্রামের এক নেতৃস্থানীয় লোক তার বাবা ভাইকে বলে, যদি তোমরা তোমাদের এই মেয়েটাকে পাকিস্তানের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দাও তাইলে এই মেয়ের উসিলায় তোমার পুরো পরিবার বেঁচে যেতে পারে। 

কোনো উপায় না থাকায় সহজ সরল বাবা মেয়ের হাত ধরে কাছের পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্পে দিয়ে আসে আমাকে। সারা রাস্তা ধরে একটা কথা বলে নাই বাপ মেয়ে। টেপরিকে দিয়েই মাথা নিচু করে ফিরে আসে।

এর পর সাত মাস টেপরি ছিল সেই পাক ক্যাম্পে। টেপরির কাছে প্রতিরাতেই আসতো তিন-চারজন পাকিস্তানি শুয়োরের বাচ্চারা। পালা করে প্রতিদিনই পাষবিক নির্যাতন করতো তারা। আর বাকি অত্যাচারের কথা মুখে বলার নয়। এভাবেই দীর্ঘ সাত মাস নিজের দেহের বিনিময়ে নিজের পরিবার ও দেশকে রক্ষা করে টেপরি বেওয়া।

এর মধ্যে সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তান ক্যাম্প থেকে বাবা টেপরিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। টেপরি ততদিনে গর্ভবতী। 

গ্রামের লোকেরা টেপরি বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে বলে। কিন্তু টেপরির বাবা তাকে বলেন, রেখে দে মা। তোর তো আর কেউ রইবে না। এই বাচ্চাই তোর একমাত্র সম্বল হবে। শেষ বয়সে তোর দেখাশোনার জন্য সেই তোকে আগলে রাখবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরই মধ্যে জন্ম হয় টেপরি বেওয়ার একমাত্র ছেলের। ছেলের নাম রাখা হয় সুধীর।  

ছোট থেকেই সুধীরের সাথে কেউ খেলত না, তার থেকে সবাই দূরে দূরে থাকত। যেন সুধীর কোনো ছোঁয়াছে রোগ। তাকে সবসময় পাঞ্জাবির বাচ্চা জারজ বলে ডাকত সবাই। অনেক অপমান সইতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সুধীর কিছুই বলত না। বলার ভাষাও ছিল না তার জানা।   

কেন কোনো প্রতিবাদ করত না- সুধীরকে জিজ্ঞেস করা হলে সুধীর বলছিলেন, ঝগড়া করতে তো লোক লাগে, কিন্তু আমার সাথে কেউ মিশত না। জীবনটা এখনো তার ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এভাবেই একাই জীবন কাটে ভ্যানচালক সুধীরের। পরিবারে মা, বউ আর দুই মেয়ে- এই সুধীরের পৃথিবী। 

গ্রামের আর কারো সাথে তাদের সম্পর্ক তেমন নেই। সুধীরের ছোট মেয়ে জনতা রায়। তিনি দিনাজপুর কে.বি.এম কলেজ অনার্স ৩য় বর্ষে অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তার দুই জমজ মেয়েকে সুধীর আগলে রাখেন। এ নিয়ে টেপরি বেওয়াসহ ৬ সদস্যের ভরণপোষণ কষ্ট করে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। টেপরি বেওয়ার সরকারি বীরঙ্গনা ভাতা বাবদ ১২ হাজার টাকা পেলেও ঋণের কিস্তি বাবদ অর্ধেক টাকা চলে যায়। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসকের দেয়া একটি অটোচার্জার সুধীরকে দেওয়া হলে তিনি এখন ভ্যান ছেড়ে অটো চালাচ্ছেন। তবুও সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম খাচ্ছেন। 

টেপরি বেওয়ার ছোট নাতনি জনতা রায় বলেন, দাদির ভাতার টাকা বাবার অটো চালানোর টাকা দিয়ে ৬ জনের পরিবারের ভরণপোষণ ও আমার লেখাপড়ার খরচ চালানো বাবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

বীরাঙ্গনা টেপরি বেওয়া বলেন, শরীর তেমন আমার ভালো নেই, কোমরে সবসময় ব্যাথা লেগেই আছে। সুধীরের সংসার টানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এ করোনাকালে ছেলের আয় কমে গেছে। সবমিলে এখনো অনেক কষ্ট করে সংসার চলে! 

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –