• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২৩  

রহিমা আক্তার মৌ

মূলত ইংরেজদের শাসন-শোষণের অবসানের পর তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শাসকচক্র এদেশের মানুষের ওপর জুলুম, নির্যাতন চালাতে থাকে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের ঝড় তোলে পর্যায়ক্রমে ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, এগারো দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে এ দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধিকারের আন্দোলনে। স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকচক্র এদেশের মানুষকে বারবার চেষ্টা করেও দমন করতে পারেনি। ৭০ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। সে নির্বাচনে বাঙালিরা জাতীয় সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, তবুও গণমানুষের রায় উপেক্ষা করে পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে এদেশে চালায় সামরিক নির্যাতন। 

৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বাধীনতার উত্তাল তরঙ্গের প্রবহমান রাজনৈতিক স্রোত বাস্তবে এসে অনুধাবন করেছিল। তাই ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমানোর পূর্বে এদেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যার জন্যে সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়ে যায়। সে নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানি হায়েনারা এদেশের ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাল ও নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

দেশটা আমাদের ছোট কিন্তু অর্জনগুলো বিশাল। সেই বিশাল অর্জনগুলো হলো— ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর। অর্জনের দিনের সঙ্গে যুক্ত হলো কালরাত্রির ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেল। স্বাধীনতা দিবসের ঠিক পূর্বমুহূর্তে বীর বাঙালির জীবনে নেমে আসে এক কালো অধ্যায়। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় সৃষ্ট হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা। এর নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু হলে এর পরের দিনই জাতির জনকের স্বাধীনতা ঘোষণা। নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। মূলত ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণেই বীর বাঙালি ক্ষেপে ওঠে। এর পরিক্রমায় বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ২৫ মার্চ ১৯৭১, মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা।

১১ মার্চ ২০১৭ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ায় এখন থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হবে। জাতীয় সংসদের স্বীকৃতির পর একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার। আন্তর্জাতিকভাবেও দিবসটি পালনের জন্য ইতোমধ্যে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ গ্রহণ করে। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বরকে ‘জেনোসাইড ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। কাজেই আমাদের কাছে সেই সুযোগ রয়েছে, জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী আমরা ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।

তেইশ বছরের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। মূলত তার আগেই ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতা বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কার্যত সেটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, যার পথ ধরে কালরাতের পর শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ পর্ব। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে বাংলাদেশের ইতিহাসে কালরাত্রিখ্যাত ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ এর স্বীকৃতি পেল।

নতুন প্রজন্মের প্রশ্ন, কি হয়েছিল সেই রাতে?

২৫ মার্চের সেই দিন শেষে নেমেছে সন্ধ্যা। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। তখনো কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালির জীবনে। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে তখন ঘুমিয়েও পড়েছে। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই করে নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তানের সৈন্যরা ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো শহরজুড়ে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো আধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডব। হকচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। মানুষের কান্না ও আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে শহরের আকাশ। মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হলো লাশের শহরে। রাজপথ, বসতবাড়ি ভেসে গেল বাংলার সোনার সন্তানের রক্তে। ঢাকা শহরের রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে তারা বাঙালি নিধন শুরু করে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল অর্ধলক্ষাধিক বাঙালিকে। আর এর মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক।

শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। পাক হানাদাররা সেই রাতে অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী শিক্ষকরাও জান্তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।

২৫ মার্চ রাত সোয়া ১টার দিকে এক দল সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধু বীরের মতো দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। এ সময় বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাতের জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল। অবশ্য গ্রেফতার হওয়ার আগেই ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিয়ারের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। আর এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছে। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের তৎকালীন শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এ দেশীয় দোসর ঘাতক দালাল, রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা।

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসনের ২৪নং বাড়িতে। ঐ বাড়ির নিচে দুপায়ে গুলিবিদ্ধ দুই মা তাদের শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছিল তাদের রক্তে। পাকিস্তানি হায়নাদাররা ভেবেছিল অন্য কোন দল হয়তো অপারেশন শেষ করে গেছে। তাই তারা আর ঐ বাড়িতে ঢোকেনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন প্রাণে বেঁচে যান।

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে তার সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতির প্রতি জাতির চিরন্তন শ্রদ্ধার স্মারক এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাকান্ডের সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও তারা ‘আমাদের’ ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়।’

বাণীতে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ‘পাকিস্তানিদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রুখে দাঁড়ান। তার নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার ও নির্যাতন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহর ও বন্দরে হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। সেই রাত থেকে পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর-রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা সারা দেশে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। হত্যা করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে। এত কম সময় ও স্বল্প পরিসরে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যার নজির বিশ্বে আর নেই। শুধু মানুষ হত্যা নয়, একই সঙ্গে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করা হয়। লাখ-লাখ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়। বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয় প্রায় এক কোটি মানুষকে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তৎকালীন ইপিআর ওয়ারলেসসহ টেলিপ্রিন্টার-টেলিগ্রামের মাধ্যমে এ ঘোষণা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।’

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঁচ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আমরা গণহত্যা প্রমাণের জন্য ফরেনসিক এভিডেন্সও জোগাড় করেছি। আর আমরা বধ্যভূমি থেকে মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড়ও পেয়েছি। এখানে ১৯৭১ সালে যা হয়েছে তা তো গণহত্যা অবশ্যই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। গণহত্যা হলো একটি জাতি, একটি জাতি গোষ্ঠী বা একটি সম্প্রদায়কে নির্মূল করণ প্রক্রিয়া। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে হিন্দু শিক্ষক এবং ছাত্রদের হত্যা করা হয় ধর্মীয় কারণে। আর পুরো বাঙালি জাতিকে নির্মূলের কাজ করে পাকিস্তানি সেনবাহিনী।’ 

তিনি আরো জানান, ‘নানা করণে বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের আন্তর্জাতিক অপতৎপরতার কারণে বাংলাদেশের গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। তবে এবার বাংলাদেশ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করায় এটা একটি বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করবে।’

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত দেশ ও জাতির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। ‘গণহত্যা দিবস’ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ৩০ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগের মহান স্বীকৃতির পাশাপাশি তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধেও চরম প্রতিবাদের প্রতীক। নানা ষড়যন্ত্র করেও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে প্রতিহত করতে না পেরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করতেই ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদাররা এ দেশের গণমানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তাদের জঘন্য এ হত্যাযজ্ঞে হাত মিলিয়েছিল তাদের দোসর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর- আলশামস বাহিনী। বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা বিশ্বের সকল গণমাধ্যমেই গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। হত্যা-নিপীড়নের ভয়াবহতায় এক কোটি বাঙালি আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতের অনেক সেনা মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আমরা তাদের পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

নির্বিচারে এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তনের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধু পঁচিশে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী নয় মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্ণতা দিয়েছিল সেই বর্বর ইতিহাসকে।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হলো আরো ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

লেখক- সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –