• মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

  • || ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে সাফল্য

প্রকাশিত: ১ এপ্রিল ২০২৪  

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বাসিন্দা বর্গাচাষী মনজুরুল ইসলাম। নিজের কোনো জমি না থাকায় অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে ১২ সদস্যের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। 
গতানুগতিক ফসল উৎপাদন আর অন্য কোনো আয়ের উৎস না থাকায় অনেক কষ্টেই দিন পার করতে হয় তাকে। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মিলন ইসলাম পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে মাঠের কাজে সহায়তা করেন। 

মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী মিলন ২০১৮ সালে এসএসসি পাশ করার পর অর্থের অভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। পরিবারের প্রয়োজনে মাঠে কাজের পাশাপাশি বাবার দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে ভাবতে থাকেন। 

একদিন মোবাইলে ইউটিউবে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন ও তার ভালো দামের বিষয়টি জানতে পেরে পেঁয়াজ উৎপাদন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার এলাকায় পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন না হওয়ায় কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
 
ঠিক এসময় উপজেলা কৃষি অফিস থেকে মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন বিষয়ে ট্রেনিংয়ের আয়োজন করা হলে এতে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে ডাক পড়ে মিলনের বাবার। বিষয়টি জানতে পেরে মিলন তার বাবার পরিবর্তে নিজে কর্মশালায় যোগ দেন। 

প্রশিক্ষণ পেয়ে চোখের সামনে সোনালী স্বপ্ন ভাসতে থাকলেও বাস্তবসম্মত জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে কাজ শুরু করতে পারছিলেন না মিলন। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। ধরে ধরে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকেন।

মিলন জানান, তার বাবা উচ্চমূল্যে জমি বর্গা নিয়ে ধান, আলু ও ভুট্টা আবাদ করতেন। কিন্তু আবাদের খরচ ও জমির মূল্য পরিশোধের পর খুব সামান্যই লাভ থাকতো। নিজেদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য স্কুল শিক্ষার্থী মিলন ভাবতে থাকেন। প্রথমে ইউটিউব দেখে, পরে তার প্রতিবেশী মামা কলিনিকান্ত রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করেন। সব শুনে মামা উৎসাহ দিলে তারা কাজে নেমে পড়েন। 

শুরুতে উপজেলা কৃষি অফিসে প্রশিক্ষণ নিয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার হাসান ইমামের পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতায় তার এলাকায় প্রথমবারের মতো পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য চাষাবাদ শুরু করেন। এজন্য তারা শুরুতে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ফরিদপুর, পাবনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। 

এজন্য মিলন সর্বপ্রথম পেঁয়াজের বীজ উপাদনের জন্য ফরিদপুর থেকে পেঁয়াজের বাল্ক সংগ্রহ করেন। হাতে নগদ অর্থ না থাকায় প্রথমবার জমি বর্গা নিতে ও খরচ যোগান দিতে বাড়ির গরু বিক্রি করে দেন।

অনেক প্রচেষ্টার পর কৃষি অফিসারের সহায়তায় ২০২২ সালে সাড়ে ৩ একর জমি বর্গা নিয়ে প্রথমবারের মতো পেয়াঁজ বীজ রোপণ করেন। এদিকে, পেঁয়াজ বীজের তেমন আবাদের প্রচলন না থাকায় ফরিদপুর থেকে পেঁয়াজ এনে প্রতিবেশী এক মামার সঙ্গে যৌথভাবে চারা রোপণ করেন তিনি। প্রথম বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে দশ লাখ টাকার পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করেন তিনি।

সরেজমিন  বিরল উপজেলার ধারমইর ইউপির গোবিন্দপুর গ্রামের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে মাঠে এখন শোভা পাচ্ছে পেঁয়াজ বীজের সাদা ফুল। শেষ সময়ের পরিচর্যায় ব্যস্ত শ্রমিকেরা। মৌমাছি সঙ্কট থাকায় কয়েকজন হাত দিয়েই পেঁয়াজ ফুলের মধু ফেলার কাজ করছেন। কেউবা নিড়ানি দিচ্ছেন। আবার একদিকে চলছে জমিতে পানি দেওয়ার কাজ।

বর্তমানে দিনাজপুর কাদের বক্স মেমোরিয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিলন ইসলাম বলেন, আর্থিক অনটনের কারণে কীভাবে  কৃষি থেকে বেশি উপার্জন করা যায় সবসময় চিন্তা করতাম। ইউটিউবে পেঁয়াজ বীজ চাষ করে অনেকের সফলতা দেখে আমিও পেঁয়াজ বীজ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথম বছরে সাড়ে তিন একরে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে দশ লাখ টাকা পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করি। সেই থেকে শুরু চলতি বছরে সাড়ে পাঁচ একর জমিতে খান জাতের পেঁয়াজ বীজ আবাদ করেছি। এরইমধ্যে পেঁয়াজ বীজ বিক্রি থেকে লাভের টাকায় জমিও কিনেছি।

মিলনের সহ-উদ্যোক্তা প্রতিবেশী কলিনিকান্ত রায় জানান, পেঁয়াজ বর্তমানে একটি লাভজনক ফসল। দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি থাকায় আমাদেরকে বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। অনেক চিন্তা করে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন শুরু করেছি। বীজ সহজলভ্য হলে এর উৎপাদন বাড়াতে চাষিরা আগ্রহী হবে।

মিলনের বাবা মনজুরুল ইসলাম জানান, অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। এ অবস্থায় মিলন পেঁয়াজ বীজের আবাদ করবে বলে জানায়। প্রথমে ভয় পেলেও সাহস করে কাজে নামে। এখন ফসলের মাঠে দাড়ালে খুব ভালো লাগে।

বিরল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হাসান ইমাম জানান, শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে ২ একর জমিতে আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়ায় চলতি বছরে সাড়ে পাঁচ একর জমিতে শীতকালীন পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। এ অঞ্চলে পেঁয়াজ বীজের উৎপাদন না হওয়ায় আবাদটিকে সফল করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ছাড়াও প্রয়োজনীয় পরিমাণ সারের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –