• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

একটি সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু করে এখন গার্মেন্টসের মালিক মিতু

প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০২২  

একটি সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু করে এখন গার্মেন্টসের মালিক মিতু             
২০০৯ সালে মাত্র একটি সেলাই মেশিন দিয়ে ঘরোয়াভাবে সেলাইয়ের কার্যক্রম শুরু করেন মিতু বেগম। এখন তিনি একটি ছোট গার্মেন্টসের মালিক। কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে এই অবস্থানে পৌঁছেছেন তিনি। তার গার্মেন্টসে নিয়মিত কাজ করছেন ৬০০ নারী।

নারী উদ্যোক্তা মোছা. মিতু বেগম জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল নুনিয়াগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। স্বপ্ন দেখেন একজন সফল উদ্যােক্তা হওয়ার। ২০০৯ সালে প্রথম একটি সেলাই মেশিন নিয়ে কাটিং ও সেলাই, হাতের কাজ, এপ্লিকের কাজ, নকশিকাঁথা, নকশি বেডশীট, বেডশীট, বুটিকের ড্রেস, চাদর, পর্দা, কুশন ও টেবিল ম্যাট তৈরি করে স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করতেন।

এভাবে যখন যে কাজের অর্ডার পেতেন তখন সেই কাজ করতেন মিতু। দিন দিন বাড়তে থাকে কাজের সংখ্যা। একা পেরে উঠছিলেন না। যুক্ত করেন গ্রামের অন্য নারীদের। এর মধ্যে গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের আওতায় পলাশবাড়ী বিআরডিবির মাধ্যমে ৩০ দিনের এমব্রয়ডারি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি নিজের কারখানার নারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে তাদেরও পলাশবাড়ী বিআরডিবি অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের সুযোগ করে দেন।

ব্যবসায়িক বুদ্ধি, রুচিবোধ, গ্রাহকের মানসিকতা ও সৃজনশীল চেতনা থাকার কারণে তার তৈরি পণ্যের মান ভালো হওয়ায় জেলা-উপজেলার গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা নিউ মার্কেট ও আড়ং থেকে একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে। তাদের অর্ডার অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে নারী শ্রমিক আরও বাড়াতে হয় তাকে। বতর্মানে মিতুর কারখানায় এবং বাড়িতে কাজ করছেন ৬০০ নারী শ্রমিক। মাসে কাপড়ের বিভিন্ন কাজের অর্ডার আসে প্রায় ৫-৭ হাজার পিস।

সংসারে টানপোড়েন থাকায় ঘরে কিছু হাতের কাজ করতেন। মা-চাচিদের কাছ থেকে শেখা হাতের কাজকে সম্বল করে শাড়িতে পুঁথি বসানো, জরির কাজ, নকশি কাঁথা, পাঞ্জাবি, বেডশীট, ম্যাক্সি, স্কার্ট, স্কার্ফ, বিয়ের পোশাক, লেহেঙ্গা, বোরকা পহেলা বৈশাখ ও পহেলা ফাগুনের পোশাক, বালিশের কভার, ডাইনিং সেটসহ ঘর সাজানোর আইটেম তৈরি করতেন শুরু করেন। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছেন অন্যদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন।

তার কারখানায়, কেউ বেডশীট, কুশনে এপ্লিকের কাজ করছেন, কেউবা শাড়ি, ওড়না, টি-শার্ট, পাঞ্জাবি, নকশিকাঁথা, সেলোয়ার-কামিজের উপর বিভিন্ন নকশা দিয়ে সুই-সুতো, জরির কাজ করছেন। গ্রামের অনেক নারী কাপড় বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাজ করে জমা দিয়ে পারিশ্রমিক নিয়ে যান। এমন আরও ২০০ নারী কাজ করেন তার সঙ্গে।

এই নারীরা সংসারের কাজ সেরে অবসর সময়ে এই কাজগুলো করেন। অতিরিক্ত কিছু আয়ও হয় তাদের। ফলে নিজের হাত খরচ মিটিয়ে সংসারের জন্যও খরচ করতে পারে। এতে সংসারেও সচ্ছলতা ফিরে এসেছে তাদের।

কারখানায় কাজ করেন তাজমিনা আকতার বলেন, ‘আমার সংসারে খুবই অভাব ছিল। কোনো কুল-কিনারা করতে পারছিলাম না। কাজও তেমন একটা জানা ছিল না। ২০১৬ সালে আমার এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে পরিচয় হয় মিতু আপার সঙ্গে। তিনি আমাকে পলাশবাড়ী বিআরডিবি অফিসের এমব্রয়ডারিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর তার কারখানায় যোগদান করি। সেই থেকে আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারছি।’

আরেক নারী শ্রমিক রুমি বেগম বলেন, ‘সংসারে সবকিছু ঘাটতি ছিল। মিতু আপা আমাকে বিআরডিবি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দিয়ে তার কারখানায় কাজ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আমি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। নিজের চাহিদা মিটিয়ে স্বামীর হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে পারছি। এটাই কম কিসের।’

কারখানা চালাতে মিতুকে সহযোগিতা করছেন তার চাচাতো বোন মুক্তা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মিতু আপুর কারখানার যেসব নারী শ্রমিক বাড়িতে কাপড় নিয়ে গিয়ে কাজ করে তাদের নাম রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ করি এবং কাপড়ের পরিমাণ লিখি। পাশাপাশি রিজেক্ট কাপড় বাছাই করি। অনেক নারী শ্রমিক আছেন যারা একটু ভুল করেছেন। আমি সেই ভুলগুলো ধরে তাদের থেকে কাজ করিয়ে নেই।’

সফল নারী উদ্যোক্তা মোছা. মিতু বেগম বলেন, ‘জীবনে কোনো কিছুই সহজ পথে আসে না। প্রতিটি পথেই কাঁটা বিছানো থাকে। আর তা উপরে ফেলার সাহস যাদের আছে কেবল তারাই জয়ী হবেন। আজ আমি সফল হয়েছি। দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ, মার্কেট থেকে বড় বড় অর্ডার আসছে আমার কাছে। তাদের চুক্তি মোতাবেক সঠিক সময়ে মানসম্মত মাল বুঝে দিতে হয়। এভাবে কাজ করে প্রতিমাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকে।’

এবিষয়ে পলাশবাড়ী উপজেলা বিআরডিবি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের ভিশন পণ্য ভিত্তিক পল্লী গঠনের লক্ষ্যে এমব্রয়ডারি ট্রেডে একমাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে মিতুকে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়। তাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।’

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –