• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

একাত্তরের ২৪ মার্চ রংপুরে যা ঘটেছিল

প্রকাশিত: ২৪ মার্চ ২০২২  

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার আগেই রংপুরে যুদ্ধ শুরু হয়। ২৪ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনসহ তিন জওয়ানকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিল রংপুরের মানুষ। তৎকালীন সাতগাড়া ইউনিয়নের (বর্তমানে রংপুর সিটির অন্তর্ভুক্ত) দামোদরপুরের দিনমজুর ও অনাহারী মানুষরা সেদিন যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা এক গর্বের ইতিহাস। তাই ২৪ মার্চ শুধু রংপুর নয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- ‘ভাতে মারব, পানিতে মারব’। সেই কথাই যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে রংপুরের বীর জনতা। সেনানিবাসে সকল প্রকার খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেনানিবাসে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। 

খাদ্য (মুরগী ও ডিম) সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর একটি জীপ সেনানিবাসের পশ্চিম দিক দিয়ে বের হয়ে নিসবেতগঞ্জ হাটে উপস্থিত হয়। সেনা সদস্যদের দেখে হতচকিত হয়ে যায় গ্রামবাসী। ওই জীপের ড্রাইভার ছিলেন একজন বাঙালি। মুক্তির নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। কয়েকজন সিদ্ধান্ত নেন আক্রমণের। চলতে থাকে প্রস্তুতি।

এসব দেখে যুবক শাহেদ আলী (পেশায় কসাই) সাইকেল চেপে আগেই নিজ গ্রামে চলে যান। দ্রুতই এই খবরটি ছড়িয়ে যায় সম্মানীপুর, দামোদরপুর, বড়বাড়ি, মনোহরপুর গ্রামের মানুষদের কাছে।

শত শত গ্রামবাসী দা, বল্লম, কুড়াল, বটি, খুন্তিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাঁশের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে জীপের জন্য।

অবশেষে জীপটি দামোদরপুর বড় ময়দান এলাকায় আসতেই পথ আটকে গ্রামে আসার কারণ জানতে চান যুবক শাহেদ আলী। তখন জীপে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবী লেফটেন্যান্ট আব্বাসীসহ তিন জওয়ান এলএমজি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাহেদের দেখাদেখি বাদশা, সালাম, রফিকুলসহ আরও তিন-চারজন যুবক জীপের কাছে গিয়ে দাঁড়ান।

পাক সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাহেদ আলী জীপের ওপরে উঠে এক টানে ছিনিয়ে নেয় এলএমজি। ঘটনাটি এতো দ্রুত ঘটেছিল যে লেফটেন্যান্ট আব্বাসী হতভম্ব হয়ে যায়। এই সুযোগে শাহেদ আলী খাপ্পর (অনেকটা বল্লম আকৃতির) দিয়ে আব্বাসীকে আঘাত করলে সে লুটিয়ে পরে।

অপরদিকে বাদশা, সালাম, রফিকুল তাদের হাতে থাকা দা, কুড়াল, বল্লম দিয়ে আঘাত হানে তিন সেনা সদস্যের ওপরে। তিনজনই তখন মৃত্যু পথযাত্রী।

গাড়ি চালক বাঙালি হওয়ায় হাত বাড়িয়েছিলেন সহযোগিতার। তাই তাকে যেন সেনানিবাসের কেউ সন্দেহ না করে সেই জন্য দা দিয়ে হালকা আঘাত করা হয় তাকে। আহত বাঙালি ড্রাইভার নিসবেতগঞ্জ পর্যন্ত জীপটি চালিয়ে আনেন।

এদিকে, হামলার সেই খবর পৌঁছে যায় ক্যান্টনমেন্টে। আহতদের নেওয়া হয় রংপুর সদর হাসপাতালে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা হাসপাতালে পাক সেনাদের চিকিৎসার বিরোধিতা করলে পাকসেনারা গুলি চালায়। তাদের গুলিতে পৌর বাজার (বর্তমান সিটি বাজার) এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আব্দুর রাজ্জাক নামে একজন। এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা।

ওই ঘটনায় শহীদ হওয়া আব্দুর রাজ্জাকের সমাধি রয়েছে নগরীর হনুমান তলা কাজী নজরুল ইসলাম সরণীতে। নগরীর শতরঞ্জি পল্লীখ্যাত নিসবেতগঞ্জ কবির মোড়ে শহীদ শাহেদ আলী নামে একটি সরণী রয়েছে। এটি ২৪ মার্চ স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ থেকে করা হয়েছে।

এদিকে সেনা সদস্যরা হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সেদিনই বিকাল ৪টার দিকে নগরীর গনেশপুর এলাকাকে ঘটনাস্থল ভেবে পুরো এলাকা জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদাররা। এর ঠিক চারদিন পর ২৮ মার্চ সাধারণ জনগণ তীর-ধনুক, বাঁশের লাঠি, দা, কুড়াল নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আক্রমণ করে। সেদিন সবার মুখে ছিল গগনবিদারী স্লোগান- ‘এসো ভাই অস্ত্র ধর, ক্যান্টনমেন্ট দখল কর’।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানা গেছে, ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনারা সারা দেশে বাঙালিদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। কিন্তু এর এক দিন আগ থেকেই রংপুরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ২৪ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনসহ তিন জওয়ানকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে রংপুরের মানুষ। এ ঘটনার পর পাকিস্তানি হায়েনার দল রংপুরে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে।

রংপুরে মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু বলেন, একাত্তরের মার্চ মাস মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর মধ্যে বিরাট এক অংশজুড়ে আছে রংপুর। এই রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কিশোর শঙ্কু। এই রংপুরে ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ এক ইউনিটকে প্রতিরোধ করেছিল দেশপ্রেমী জনতা এবং এখানেই ২৮ মার্চ সংঘটিত হয় আরেক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –