• সোমবার ২০ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

জোড়াতালির টাকায় ৩৫ বছর কেটে গেলো কামরুল হাসানের

প্রকাশিত: ৩০ জুন ২০২২  

গাইবান্ধা পৌর শহীদ মিনার মোড় ঘেঁষে সালিমার সুপার মার্কেট। মার্কেটের সামনের ফুটপাতে দেখা গেলো কাঠের ছোট একটি টেবিল। টেবিলের সঙ্গেই জোড়া লাগানো ছোট একটি বেঞ্চ। টেবিল ও বেঞ্চের ওপরে একটি ছাতা।

টেবিলের ওপর কাঁচি, আঠা, টেপ ও পাউডারের ছোট কৌটা। থরে থরে সাজানো পুরোনো ছেঁড়াফাটা টাকার নোট। সেসব ছেঁড়াফাটা নোটের ওপর বিশেষ ধরনের টেপ মেরে চলেছেন আশির দশকের ফুটবলার সৈয়দ কামরুল হাসান।

শহরের মাস্টারপাড়ায় তার বাড়ি। প্রথম স্ত্রী মৃতুর পর দ্বিতীয় স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। পৌর শহীদ মিনার মোড়েই ৩৫ বছর ধরে ছেঁড়াফাটা টাকার ব্যবসা করছেন তিনি।

সম্প্রতি কাজের ফাঁকে কথা বলেন কামরুল হাসান। তিনি জানান, সংসারের বড় ছেলে তিনি। পাড়ার আর দশটা ছেলের মতোই খেলাধুলা করেই দিন কাটতো। কিশোর বয়সে পাড়ার মঞ্চে নাটকের অভিনয়ও করেছেন অনেক। এসএসসি পরীক্ষার পর বাবা মারা যান। ছোট ভাইবোন নিয়ে পরিবারের দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। সংসার চালাতে কাপড়ের ব্যবসা করলেও পুঁজি হারিয়ে ছেঁড়াফাটা টাকার ব্যবসা শুরু করেন।

তিনি বলেন, শহরে খায়রুল ইসলাম ও স্বপন কুমার সাহা নামের আর দুজন ছেঁড়াফাটা টাকার ব্যবসা করেন। তারা তার কাছ থেকে কমিশনে এসব টাকা কিনে নেন।

টাকা কিনে কী করেন, জানতে চাইলে খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘শহরে প্রতিদিন ব্যবসায় বসি না। উপজেলাগুলো থেকে কমিশনে খুচরা মূল্যে ছেঁড়াফাটা টাকা কিনে এনে রংপুর-বগুড়ার মহাজনদের কাছে বিক্রি করি।’

কথা বলতেই শুভ মিয়া নামের এক ব্যক্তি আসেন কামরুল হাসানের টেবিলের সামনে। পলিথিন মোড়ানো কাটাছেঁড়া টাকা পকেট থেকে বের দিলেন। ছেঁড়াফাটা টাকাগুলো রেখে শুভ মিয়াকে ভালো কিছু নোট দিলেন কামরুল হাসান। এ বাবদ কিছু টাকাও কেটে রাখলেন তিনি। এটাই কামরুল হাসানের ব্যবসা। নিদির্ষ্ট কমিশন নিয়ে মানুষের কাছ থেকে ছেঁড়াফাটা টাকা নিয়ে সচল নোট দেন তিনি। এভাবেই চলে প্রতিদিন তার ব্যবসা।

একটু পরেই সদরের দক্ষিণ ধানঘড়া গ্রামের মিশুক ১০০ টাকার পাঁচটি ছেঁড়াফাটা নোট জমা দিয়ে ৩৫০ টাকার ভালো নিলেন। জানতে চাইলে মিশুক বলেন, ‘ছেঁড়াফাটা টাকা দিয়ে ভালো টাকা পেলাম। যাই পেলাম সেটাই লাভ। কারণ আমার ৫০০ টাকা তো অচলই ছিল।’ তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কামরুল হাসানকে এখানে ব্যবসা করতে দেখছি। টাকা নষ্ট হলে তার কাছেই আসতে হয়।

একটু অপেক্ষা করতেই মিজানুর রহমান নামের পুরাতন বাজারের এক মুদিদোকানি আসেন সেখানে। তিনি কামরুল হাসানের কাছে কিছু ছেঁড়াফাটা টাকা দিয়ে ভালো টাকা নিলেন।

এ সময় মিজানুর রহমান বলেন, ‘দোকানে অনেক সময় নিজের অজান্তেই ছেঁড়াফাটা টাকা দিয়ে কাস্টমাররা চলে যান। সেগুলো রেখে দেই। বেশি টাকা হলে কামরুল ইসলামের কাছে দিয়ে কিছু ক্ষতি শিকার মেনে নিয়ে ভালো টাকা নিয়ে যাই।’

ব্যবসা কেমন লাগে জানতে চাইলে কামরুল হাসান বলেন, ‘বহু বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। ভালোই লাগে। প্রতিদিন যা রোজগার হয় তা দিয়ে ভালোই চলে সংসার। বন্ধুদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি টাকার কাজ করতি করতি প্রায় বুড়োই হয়ে গেলাম। খাইয়ে-পইরে ওপরওয়ালা ভালোই রাখছে। ৭০ বছর বয়সে কী আর করবো? এ ব্যবসায় যত ইনভেস্ট করবেন তত রিস্ক বেশি। আবার ততবেশি লাভ।’

প্রতিদিন ব্যবসা কেমন হয় জানতে চাইলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কামরুল হাসান। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন একরকম হয় না। সাধারণত ১০০ টাকা নিয়ে গ্রাহককে ৭০ টাকা দিতে হয়। তবে টাকা ছেঁড়াফাটার ওপর নির্ভর করে কমবেশি হয়। বেশি কাটাছেঁড়া হলে কেটে রাখার পরিমাণটাও বাড়ে। ১০ টাকা কমিশনে বাইরে বিক্রি করি। দিনে দু-একটা বিদেশি টাকার নোট আসে, তবে সে নোট আমি নেই না। প্রতিদিন ৫০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়।’

কামরুল হাসান বলেন, “আগে যাই ইনকাম হতো বাজার খরচ করেও ২০-৫০ টাকা পকেটে থাকতো। এখন আর থাকে না। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। এভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকলে খুব খারাপ অবস্থায় দিন কাটাতে হবে আমাদের। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের মতো পকেটে আর টাকা জমে না। তবে পকেটে টাকা না থাকলেও মানুষ ‘টাকাওয়ালা’ নামেই আমাকে চেনে।”

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –