• বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

  • || ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

পাট-হোগলা পাতার কারুপণ্যে ৫ শতাধিক পরিবারের কর্মসংস্থান

প্রকাশিত: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪  

উত্তরের জেলা দিনাজপুরের খানসামা থেকে পাট আর হোগলা পাতায় তৈরি কারুপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে একজন উদ্যোক্তার। সেই সঙ্গে এসব কারুপণ্য প্রস্তুতকারক কারখানায় কাজ করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পথে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার। পণ্যের গুণগত মান আরও বাড়িয়ে রপ্তানি বৃদ্ধিসহ দেশীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে ‘রংজুট বিডি কোম্পানি’ নামের ওই কারখানাটি। 

সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, এই কোম্পানি খানসামা উপজেলার আলোকঝাড়ী ইউনিয়নের বাসুলী কালাম চেয়ারম্যান পাড়ায় আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত। মূল রাস্তা থেকে এই কারখানাটিতে প্রবেশ করতেই দেখা গেল সুই-সুতো দিয়ে পাট ও হোগলা পাতার নিত্যনতুন পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা। অন্যদিকে আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে পণ্য তৈরিরও কাজ চলছে। 

প্রশিক্ষিত এই নারীদের মাধ্যমে পাট ও হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি হোগলা বাস্কেট, ফ্লোর রাক্স, ওয়াল ডেকর, ফ্লোর ম্যাট, পাপোশ, ডোর ম্যাট, আয়না ও দোলনাসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। 

সেখানে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানাটিতে ৪০ জন নারী-পুরুষ স্থায়ীভাবে কাজ করেন। এ ছাড়া বাড়ির কাজের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত এই কোম্পানিতে কাজ করেন ৫ শতাধিক নারী। তাঁরা তাঁদের বাড়িতে কাজ করেই কাঙ্ক্ষিত পণ্য সরবরাহ করেন। স্থায়ী শ্রমিকেরা প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা মূল বেতনের সঙ্গে কাজের ওপর বোনাস পেয়ে থাকেন। এর বাইরে যাঁরা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাঁরা কাজের ভিত্তিতে পারিশ্রমিক পান। 

ওই কারখানায় সাহেবানী নামে এক নারী বলেন, ‘বাড়িতে বসে না থেকে এখানে কাজ করে কিছু টাকা আয় করলে সংসারের জন্য অনেক উপকার। বাড়ি থেকে এখানে যাতায়াতও সহজ।’ 

রুবিনা বেগম নামে এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘এইখানে প্রায় ৭-৮ মাস থেকে কাজ করি। আমার দুই ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে। তাদের খরচ আর সংসারের জন্য আমার উপার্জনের এই টাকা কিছুটা হলেও কাজে লাগে।’ 

শান্তিবালা নামে ৬০ বছর বয়সী এক নারী বলেন, ‘গরিব মানুষ বাহে! পেটের ক্ষিদায় এইখানে কাজ করি। কিছু পাইসা কামাই করি, তাই দিয়্যা তো মোর সংসার চলে।’  এ প্রতিষ্ঠানের কোয়ালিটিম্যান হিসেবে কর্মরত যুবক আনারুল বলেন, ‘বাড়ির কাছে এই কোম্পানি হওয়ায় এলাকার মানুষের এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে। এতে আমরা অনেক খুশি। সে জন্য আজাদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ।’ 

৩২ বছর বয়সী তরুণ উদ্যোক্তা প্রকৌশলী কাইদুজ্জামান আজাদের উদ্যোগে এই কারখানাটি প্রস্তুত করা হয়। তাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানার পণ্য এখন বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করা হয় এসব পণ্য। সেই সঙ্গে অনলাইনের মাধ্যমেও এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, ‘টেক্সটাইল বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। তখনই নজরে আসে এই পণ্য তৈরির কাজ ও বিশ্ববাজারে এর চাহিদা। পরবর্তী সময়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসে ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানির কাছে প্রাথমিক ধারণা ও অর্ডার নিয়ে ২০১৬ সালে নিজ গ্রামে এই কারখানার যাত্রা শুরু করি। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে এই কাজের পরিধি ও কর্মসংস্থান।’ 

তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টাকা স্থায়ীভাবে বিনিয়োগ করেছেন কাইদুজ্জামান আজাদ। সেই সঙ্গ প্রতি মাসে কাঁচামাল, শ্রমিক মজুরি, বিদ্যুৎ বিল ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ তাঁর প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা ব্যয় মিটিয়ে প্রতি মাসে তাঁর আয় এখন এক থেকে দেড় লাখ টাকা। তবে অনেক সময় কোম্পানিতে ভর্তুকি দিতে হয় বলে জানান তিনি। 

রংজুট বিডির স্বত্বাধিকারী কাইদুজ্জামান আজাদ বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এক্সপোর্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক এই পণ্যগুলো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। গড়ে প্রতি মাসে ২৫-৩০ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানি, ঢাকা, খুলনা ও রংপুরের বিভিন্ন শোরুমে প্রতিনিয়ত পণ্য সরবরাহ করা হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা পেলে এই কাজের পরিধি আরও বাড়ানো সম্ভব। যেটি হলে আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে।’ 

এ বিষয়ে খানসামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তাজউদ্দিন বলেন, ‘প্রত্যন্ত এই অঞ্চলে কারুপণ্য তৈরি ও বিক্রির জন্য কোম্পানি প্রতিষ্ঠা ও চালু রয়েছে এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এই কাজের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। সেই সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন সব সময় তাঁর ইতিবাচক কাজের পাশে থাকবে।’

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –