• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ২ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

প্রসার ঘটছে কাচশিল্পের

প্রকাশিত: ৩০ অক্টোবর ২০২২  

কাচের আয়নার ব্যবহার বেশ পুরোনো। তবে এখন আর শুধু চেহারা দেখার আয়নাতেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ নয়। ঘর, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, আসবাব, পরিবহন, ইলেকট্রনিকস পণ্যসহ নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগছে কাচ। এমনকি এর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে দেশে এ খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ছে। তিন দশক আগেও চাহিদার বেশিরভাগ আমদানি করে মেটাতে হতো। সেই আমদানি-নির্ভরতা কাটিয়ে এখন কাচ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।

দেশে কাচশিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে ১৯৬১ সালে, উসমানিয়া গ্লাসশিট কারখানার মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর বেসরকারি মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ হয়। শুরুতে বেশ লাভজনক থাকলেও নব্বই দশকের পর থেকে পরিণত হয় লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। তখন উৎপাদন হতো শুধু সাদা-কালো গ্লাস। রঙিন গ্লাসের চাহিদা মেটানো হতো বিদেশ থেকে আমদানি করে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে রঙিন কাচের চাহিদাও। এ চাহিদা মেটাতে এগিয়ে এসেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।

১৯৯৭ সালে বেসরকারি খাতে প্রথম শিট গ্লাস উৎপাদন শুরু চট্টগ্রামের এমইবি গ্রুপের হাত ধরে। যদিও দৈনিক ৫০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কারখানাটি এখন বন্ধ। এরপর গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে নাসির গ্রুপ ও পিএইচপি পরিবার এ খাতে বড় আকারের বিনিয়োগ করেছে। নাসির গ্রুপের নাসির গ্লাস ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে দুটি এবং পিএইচপি পরিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি কারখানা স্থাপনের পর কাচের আমদানি-নির্ভরতা কমে এসেছে।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি মেটানো হচ্ছে স্থানীয় কাচ দিয়ে। বাজারও প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। বর্তমানে এর বাজার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া সরকার প্রতিবছর ভ্যাট, আয়কর ও কাঁচামালের আমদানি শুল্ক্ক বাবদ প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পাচ্ছে এ খাত থেকে।

দিন দিন বাড়ছে চাহিদা

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ক্ষেত্রে বাড়ছে কাচের চাহিদা। সংশ্নিষ্টদের তথ্যমতে, এ চাহিদা বাড়ার হার বছরে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। যদিও করোনার কারণে তা কিছুটা কমে এসেছে। দেশে এখন বছরে কাচের চাহিদা প্রায় আড়াই লাখ টন। এ খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, আগামী দুই দশক পর ৮ থেকে ১০ গুণ বাড়বে কাচের ব্যবহার। কাচের ব্যবহার বাড়ছে- এমন খাতের ব্যবসায়ীরাও অনেকটা তাই মনে করছেন। যেমন- আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রথম সহসভাপতি কামাল মাহমুদ সমকালকে বলেন, আগামীতে আবাসন ভবন যত বেশি তৈরি হবে, কাচের চাহিদাও তত বাড়বে। কাচশিল্পেরও আরও বেশি প্রসার ঘটবে। দেশে উৎপাদন বাড়লে ক্রেতার জন্য গ্লাস সহজলভ্য হবে।

উৎপাদনে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান

সব মিলিয়ে দেশে বছরে প্রায় চার লাখ টনের বেশি কাচ উৎপাদন হয়। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ঢাকার নাসির গ্রুপ। ২০০৫ সালে উৎপাদন শুরু করা এ গ্রুপের রয়েছে দুটি বড় কারখানা। যেগুলোর দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার টন। প্রকৃত দৈনিক উৎপাদন ৮০০ টনের বেশি। চট্টগ্রামের পিএইচপি পরিবারও ২০০৫ সালের দিকে কাচ উৎপাদনে এসেছে। দৈনিক ৩০০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কারখানা রয়েছে গ্রুপটির। যদিও দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টন উৎপাদন করে তারা। এ ছাড়া ২০১৮ সালে কাচশিল্পে যাত্রা শুরু করা বগুড়ার এবি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ দৈনিক ৬০ টন উৎপাদন করে। রাষ্ট্রায়ত্ত উসমানিয়া গ্লাসশিট কারখানা থেকে আসে দিনে ২২ টন।

উল্লেখ্য, কাচ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিলিকা বালু, যা দেশের বিভিন্ন এলাকা ও পাহাড়ে পাওয়া যায়। কাচে এ বালুর পরিমাণ থাকে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ থাকে সোডিয়াম কার্বনেট, চুনাপাথর, ডোলোমাইট, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড রং বা ব্লিচ ইত্যাদি। প্রথমে সিলিকা বালু ও চুনাপাথরকে ১৪০০ থেকে ১৬০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় গলিয়ে তরল করা হয়। এরপর এর সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক মেশানো হয়। নানা ধাপ পেরিয়ে তৈরি হয় স্বচ্ছ কাচ। কাচ শতভাগ ফের ব্যবহারযোগ্য পণ্য। ভাঙা কাচকে গলিয়ে ফের নতুন কাচ তৈরি করা যায়।

বড় হচ্ছে রপ্তানি বাজার

দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে দেশে উৎপাদিত কাচ। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে পণ্যটির রপ্তানি বাজার। এ খাতের রপ্তানিতে সরকার এখন ২৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে। রপ্তানি বাণিজ্যে সাফল্য এসেছে মূলত নাসির গ্রুপ ও পিএইচপি পরিবারের হাত ধরে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের বেশি রপ্তানি আয় এসেছে কাচ ও কাচের পণ্য থেকে। তার আগের অর্থবছরের চেয়ে যা প্রায় ১৩৫ শতাংশ বেশি। যদিও চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত রপ্তানির গতি কিছুটা কম। প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানি হয়েছে ১৬ লাখ ডলারের।

প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ আফ্রিকা অঞ্চলেও রপ্তানি হচ্ছে দেশে উৎপাদিত কাচ। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ফ্লোট গ্লাস। রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৭০ শতাংশের বেশি যায় ভারত ও নেপালে। প্রচলিত বাজার হিসেবে উগান্ডা, তানজানিয়া, কেনিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেও রপ্তানি হচ্ছে।

আমদানি কতটা হচ্ছে

আমদানিকারকরা বলছেন, দেড় যুগ আগে চাহিদার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাচই আমদানি হতো। দেশে এখন উৎপাদন অনেক বেড়েছে। তবে আমদানি একেবারেই কমে যায়নি। দেশীয় কারখানায় যেসব কাচ উৎপাদন হয়, সেগুলোর আমদানি কমেছে। কিন্তু যেগুলো উৎপাদন হচ্ছে না, সেগুলো আমদানি হচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য, গাড়িতে ব্যবহারের কাচ ও জানালায় ব্যবহারের জন্য উন্নতমানের কাচ আমদানি হচ্ছে বেশি।

বাংলাদেশ গ্লাস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হোসাইন আলমগীর বলেন, বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ কাচ উৎপাদন হয়, তা মোট চাহিদার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মেটাতে পারে। বাকি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আমদানি করা হয়। চাহিদায় বৈচিত্র্য আসায় বিভিন্ন ধরনের কাচ আমদানি হচ্ছে, যেগুলো দেশে উৎপাদন হয় না। মাসে ১২ থেকে ১৪ হাজার টনের বেশি কাচ আমদানি হয়, যার সিংহভাগই আসে চীন থেকে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকেও আমদানি হয়।

আসছে নতুন বিনিয়োগ

নানা ক্ষেত্রে কাচের চাহিদা বাড়তে থাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে এই খাতে। কাচশিল্পে নাসির গ্রুপের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ রয়েছে। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে আরেকটি কারখানা চালু করতে তারা বিনিয়োগ করবে এক থেকে দেড় হাজার কোটির টাকার মতো।

পিএইচপি পরিবারের রয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি বিনিয়োগ। গত সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন বিশেষায়িত শব্দনিরোধক কাচ উৎপাদনের একটি ইউনিট চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সুলতান মাহমুদ সমকালকে বলেন, ভবিষ্যতে এ খাতে নতুন নতুন পণ্য আসবে। তাই আরও বিনিয়োগ হবে তাঁদের।

নতুন করে বড় বিনিয়োগে যাচ্ছে এবি গ্লাসও। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি কারখানা করবে তারা। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান বলেন, ২০২৩ সালের শুরুর দিকে বগুড়ায় নতুন করে আরেকটি কারখানা চালু হবে তাঁদের। সেখানে দৈনিক প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টন কাচ উৎপাদন হবে। এ ছাড়া আকিজ গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপও বিনিয়োগে আসছে বলে জানা গেছে।

সম্ভাবনার সঙ্গে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ

উদ্যোক্তারা জানান, এ খাতের উৎপাদনে বড় বিনিয়োগের দরকার হয়। কাচ কারখানার চুল্লি কোনো কারণে বন্ধ হলে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়। তাই কারখানা চালু রাখতে পাঁচ-ছয় মাসের কাঁচামাল সবসময় প্রস্তুত রাখতে হয়। কিন্তু সিলিকা বালু ছাড়া আমদানি করতে হয় বাকি সব কাঁচামাল। এ ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা রয়েছে। যে দেশ থেকে কাচ উৎপাদনের মেশিনারিজ আনা হয়, মেশিন পরিচালনার মূল দায়িত্ব থাকে তাদের হাতে। মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয় তাদের পেছনে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ প্রয়োজনীয় কিছু নীতি-সহায়তা দিলে ভবিষ্যতে রপ্তানিতে বড় অবদান রাখতে পারবে কাচশিল্প। এ ছাড়া তৈরি করা কাচ আমদানিতে শুল্ক্ক এবং রপ্তানিতে প্রণোদনা বাড়ানোর দাবি জানান তাঁরা।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –