• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

২৪১০ জঙ্গি গ্রেপ্তার করেও সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, চলছে পুনর্বাসন

প্রকাশিত: ১ জুলাই ২০২২  

সাবধানতা ও সতর্কবার্তার মধ্যেই ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঘটে যায় ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গি হামলা। ওই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গি-উগ্রবাদ মোকাবিলায় জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেন। শুরু হয় একের পর এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান। হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে এক হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ৪১০ জঙ্গিকে। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি।

আজ (১ জুলাই) সেই হলি আর্টিজান হামলার ছয় বছর। জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কল্যাণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ মুহূর্তে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার হুমকি ও আশঙ্কা কোনোটিই নেই। সে ধরনের সক্ষমতাও জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেই। হলি আর্টিজান হামলার পর সব জঙ্গির সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে জঙ্গি-উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে। আর অনলাইন প্লাটফর্মকে গুরুত্ব দিয়ে নজরদারিও বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জঙ্গি তৎপরতা কমে এলেও আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। যারা জামিনে বেরিয়েছেন, তাদের ওপর নজর রাখা, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিপথগামীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও তরান্বিত করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০১৩ সাল থেকে ব্লগার, লেখক-প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা মতাবলম্বীদের ‘টার্গেটেড কিলিং’ চলার মধ্যেই ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ডিএমপিতে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট নামে নতুন একটি জঙ্গিবিরোধী ইউনিট গঠন করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)।

সিটিটিসির অভিযানে গ্রেপ্তার ৫৫৯ জঙ্গি

সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজান হামলার পর গত ছয় বছরে জঙ্গি সংগঠনগুলোর ৫৫৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে জেএমবির ৯৯ জন, নিউ জেএমবির ২০৪ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ১৩৬জন, হরকাতুল জিহাদের ১০জন, হিযবুত তাহরীরের ৩৪ জন এবং সংগঠন উল্লেখ নেই এমন উগ্র ও সহিংসতায় বিশ্বাসী ৭৬ জন।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ১ হাজার ৬৭৮ জঙ্গি

হলি আর্টিজান হামলার পর পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাবের ৭৭৯ অভিযানে ১ হাজার ৬৭৮ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সন্ধান পাওয়া ৫৪ জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়েও দিয়েছে সংস্থাটি।  গ্রেপ্তারদের ৮৩৬ জন জেএমবির সদস্য,  ৮৬ জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের, ৩০ জন হুজি সদস্য, ৮৮ জন হিযবুত তাহরীরের, একজন শহীদ হামজা ব্রিগেডের, ৪০৬ জন আনসার আল ইসলামের, ২০১ জন আল্লাহর দলের, একজন মানহাজী ও একজন গায়েরী এহসারের।

এসব অভিযানে আত্মসমর্পণ করেন ১৬ জঙ্গি সদস্য। উদ্ধার করা হয় ৬৫ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, ২৫২ রাউন্ড গোলাবারুদ, গ্রেনেড, ১০২ রাউন্ড বোমা ও ককটেল, ৮০টি ডেটোনেটর (ইলেকট্রিক ও নন ইলেকট্রিক), ১৬ কেজি বিস্ফোরকসহ জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিপুল পরিমাণ বই, সিডি ও লিফলেট।

এটিইউয়ের ১০৮ অভিযানে ১৭৩ উগ্রবাদী গ্রেপ্তার

হলি আর্টিজান হামলার পর ১০৮ অভিযানে ১৭৩ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। ২০১৯ সালে ২৭ জন, ২০২০ সালে ৬৩ জন, ২০২১ সালে ৫৬ জন এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৯ অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৭ জঙ্গি সদস্য। ১৭৩ জঙ্গির মধ্যে জেএমবির ১৪, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৪৮, আল্লাহর দলের ৩১, হিযবুত তাহরীরের ২৫, আনসার আল ইসলাম ২৪, অনলাইন প্রতারক ১১, হেফাজতে ইসলাম ৪ ও অন্যান্য ৫ জন।

আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শে র‌্যাবই প্রথম জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেয়। শুরু হয় বিপথগামী জঙ্গি সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে র‌্যাবের তৎপরতা। ডি-রেডিক্যালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল (আরডিআরসি) সংগঠনের মাধ্যমে জঙ্গিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে চায় র‌্যাব। আহ্বানে সাড়া দিয়ে বগুড়া, রংপুর ও কুষ্টিয়াতে আত্মসমর্পণ করেন ৭ জন বিপথগামী তরুণ।

২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘নব দিগন্তের পথে’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ৬ জন জেএমবি এবং ৩ জন আনসার আল ইসলামের সদস্যসহ মোট ৯ জন জঙ্গি সদস্য ‘বিনা শর্তে’ আত্মসমর্পণ করেন। পুনর্বাসনের জন্য তাদের প্রত্যেককেই নিজস্ব তহবিল থেকে ৫ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি ট্রাক্টর, গরুর খামার, বাই-সাইকেল ইত্যাদি সহায়তা দেয় র‌্যাব।

এ বিষয়ে র‌্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব বহুমুখী কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমন কার্যক্রমে কাজ করছে। যখনই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে, তখনই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, শুধুমাত্র অভিযান নয়, জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গড়তে ও জনসম্পৃক্ততা অর্জনে র‌্যাব ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। অন্যদিকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জঙ্গিদের অর্থের উৎস এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরকপ্রাপ্তি বন্ধ করতেও র‌্যাবের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ আটজনকে পুনর্বাসন করেছে সিটিটিসি

জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলে সেই সুযোগও রেখেছে সিটিটিসি। ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়ায় আটজনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও ব্যক্তিদের পুনর্বাসনবিষয়ক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এ বিষয়ে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, একদিনেই কেউ জঙ্গি হয়ে ওঠেন না। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তার যে পরিবর্তন আসে, সেটা যদি খেয়াল রাখি, তাহলে বিস্তার রোধ করা সম্ভব। আর কেউ যদি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান, তাহলে আমরা স্বাগতম জানাই। আমাদের সে ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। কেউ যদি এ রকম থাকে, ফিরতে চান, তাহলে যোগাযোগ করলে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব, ভূমিকা রাখব।

৬৪ জেলায় সিটিটিসির জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম চলছে

সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একত্রিত করে জঙ্গিবাদবিরোধী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম দেশজুড়েই পরিচালনা করছে সিটিটিসি। এ বিষয়ে সিটিটিসির ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মিশুক চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডি-রেডিক্যালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন চলমান প্রক্রিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এটি শুরু হয়েছে। জঙ্গিবাদ খারাপ, ভুল পথ। জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সেমিনার, ওয়ার্কশপ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়াও বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় জনসচেতনতামূলক পথনাটক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সুশীল সমাজ, গণ্যমান্য ধর্মীয় নেতাকর্মী, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী, আনসার ও কারা কর্তৃপক্ষ ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

সাইবার স্পেসে জঙ্গি তৎপরতা রোধে ২৪ ঘণ্টা পেট্রলিং

হলি আর্টিজান হামলাই ছিল প্রত্যক্ষ ও সবচেয়ে বড় হামলা। এরপর ছোট-বড় পরিসরে হামলার চেষ্টা চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তা ব্যর্থ হয়েছে। প্রত্যক্ষ কার্যক্রমে ব্যর্থ হয়ে অনলাইন প্লাটফর্মে ব্যাপকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে জঙ্গি ও উগ্রবাদী সংগঠনগুলো।

এ বিষয়ে মিশুক চাকমা বলেন, হলি আর্টিজান হামলার পর চলতি জুন পর্যন্ত সাইবার স্পেসে জঙ্গি কার্যক্রমে তৎপর এমন ৪৭২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি। অনলাইন প্ল্যাটফর্মকেন্দ্রিক সিটিটিসির বিভিন্ন ইউনিট মনিটরিং বাড়িয়েছে। আমাদের ২৪ ঘণ্টা সাইবার পেট্রলিং চলছে। আমাদের সার্বক্ষণিক তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা এখন সাইবার স্পেসেও নিরাপদ নয়।

এটিইউয়ের পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, এটিইউ পুলিশের নতুন জঙ্গিবিরোধী ইউনিট। সারাদেশেই আমাদের কার্যক্রম চলমান। সব বিভাগীয় শহরে অফিস স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। একজন অ্যাডিশনাল ডিআইজির নেতৃত্বে এ অফিসগুলো পরিচালিত হবে। সামনের দিনগুলোতে জঙ্গি-উগ্রবাদ মোকাবিলায় অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

প্রত্যক্ষ জঙ্গি কার্যক্রম বা হামলা হচ্ছে না বলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই বলে মনে করেন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী সিকদার। তিনি বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে সক্রিয়। ছোটখাটো হামলা করে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া ও সক্ষমতাও পরীক্ষা করে দেখছে। একটি জায়গায় রাষ্ট্র এখনো ব্যর্থ, তা হলো উদ্বুদ্ধকরণের কাজ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে ধর্মান্ধতার ঝুঁকি বেড়েছে। এতে করে উদ্বুদ্ধকরণের কাজটা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সহজ হয়েছে। জঙ্গিরা বসে নেই, অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক, রাজনৈতিক সংশ্লেষও আছে। এসব ভেঙে দিতে হবে।

আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সশস্ত্র তৎপরতা রোধ করা-ই জঙ্গিবাদ গুঁড়িয়ে দেওয়া নয়। প্রত্যক্ষ কার্যক্রম না থাকলেও মানুষের ধর্মান্ধতার সুযোগে তারা উদ্বুদ্ধকরণের কাজ বাড়িয়েছে। এটি চলতে থাকা মানে বড় ধরনের ঝুঁকি ও হুমকি রয়ে যাওয়া।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –