• রোববার ০৫ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মেয়েদের ঝরে পড়া চুলে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা

প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

মেয়েদের ঝরে পড়া চুল দ্বারা দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। দিনাজপুরের চিরিবন্দর উপজেলায় নিজ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শত শত চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা।

এসব কারখানার অধিকাংশই উপজেলার রানীরবন্দর এলাকার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থিত। এতে প্রায় ১০ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় পাশাপাশি বদলে গেছে তাদের ভাগ্য। নারী-পুরুষ কাজ করে হচ্ছেন স্বাবলম্বী।

নারী শ্রমিকেরা দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে গুটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কারের কাজ করে থাকেন। এতে তারা পেয়ে থাকেন ১০০ টাকা। সেই হিসেবে একজন নারী শ্রমিক মাসে এই কাজ করে আয় করেন ৩ হাজার টাকা। তবে একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতন ১৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

নারী শ্রমিকেরা বলছেন, বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী এই মজুরি দিয়ে তাদের জীবন চালানো সম্ভব নয়। তবুও উপায় না পেয়ে সংসারের অভাব দূর করতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

এই গুটি চুল প্রথমে মহিলা শ্রমিকের মাধ্যমে গুটি ছাড়িয়ে আলাদা করে প্রাথমিক পরিষ্কার এবং বাছাই কাজ করা হয়। এরপর এই বাছাই করা চুলগুলো ডিটারজেন্ট পাউডার ও শ্যাম্পু দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয়বারের মতো পরিষ্কার করা এই চুল কারখানার ভেতরে নিয়ে কাটিং মেশিনের মাধ্যমে কাচি করা হয়। কাচি করা চুলগুলোকে একইসঙ্গে রাবার দিয়ে ছোট ছোট গোছায় বেঁধে আলাদা করা হয়। কারখানায় এই ছোট ছোট গোছা করা চুলগুলোকে বলা হয় লাচি।

এবার এই লাচি করা চুল পুনরায় শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করে ধুয়ে বাতাসে শুকানো হয়। শুকিয়ে চুল যখন উজ্জ্বল হয় তখন এগুলোকে শেষবারের মত কাটিং মেশিনে নেওয়া হয় ফিতা দিয়ে মেপে গ্রেডিং করে রেমি তৈরির জন্য। এই রেমি করা চুলই কারখানা থেকে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হওয়া চুল। এরপর কারখানা মালিকেরা নিজেরাই ঢাকায় গিয়ে চুল বিক্রি করে থাকেন। রেমি (প্রক্রিয়াজাতকরণ) চুলের দৈর্ঘ্যের উপরই এর মূল্য নির্ভর করে। চুল যত লম্বা হবে বাজার দরও তত বেশি হবে। চুলের এই দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে এর বাজার মূল্য সর্বনিম্ন ৬ ইঞ্চি চুল ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২-৩২ ইঞ্চি সাইজের চুল প্রতিকেজি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২২ ইঞ্চি থেকে ৩২ মাপের লম্বা চুলকে সর্বোচ্চ গ্রেডের চুল বলা হয়।

নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা এই চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সৃষ্টি করেছে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এই খাতে বিনিয়োগও করছে। ফলে ছোট একটি খাত হলেও সেটি ধীরে ধীরে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে।

নারী শ্রমিক হামিদা খাতুব বলেন, আমাদের এলাকায় এখন অনেক চুলের কারখানা। আমরা গরীব মানুষ দিন আনি দিন খাই। বাসায় বসে না থেকে এখানে চুলের কাজ করি। সারাদিন কাজ করে ১০০ টাকা পাই। মাসে ৩০ দিন কাজ করলে তিন হাজার টাকা পাই। বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম বেশি কিন্তু আমাদের মত নারী শ্রমিকদের মজুরি কম।

আরেক নারী শ্রমিক তহিদা বানু বলেন, আমরা মেয়েদের মাথা থেকে পড়ে যাওয়া  চুলের কাজ করি। এ চুলগুলো জটলা লেগে থাকে সেগুলো আমরা কাটা দিয়ে আস্তে আস্তে খুলি। সকাল বেলা বাড়ির কাজ করে ৮টার দিকে কারখানা আসি। আবার নাস্তার জন্য ১০টার সময় ৩০ মিনিট ছুটি পাই। নাস্তা খেয়ে আমার বসি কাজে। ঠিক দুপুর হলে খাবারের জন্য আবার ১ ঘণ্টা সময় পাই। এর পরে বিকাল কোনোদিন ৫টা আবার কোনোদিন ৬টায় উঠি। তার পরে ১০০ টাকা মজুরি পাই। এ টাকা দিয়ে সংসার চলে না। কিন্তু উপায় না পেয়ে কষ্ট হলেও কাজ করতে হয়ে।

নারী শ্রমিক মরিয়ম বেগম বলেন, চুলের কারখানায় সারাদিন কাজ করে ১০০ টাকা পাই। পোষায় না কিন্তু উপায় নাই। এই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচটা দিতে পারি। এজন্য কষ্ট করে হলেও কাজটা ছাড়ছি না।

চুলের মিস্ত্রী রাব্বি সরকার বলেন, আমি ঢাকা থেকে এখান এখানে কাজ করতে আসছি। প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করতে পারি।

চুলের কারখানার মালিক মিজানুর রহমান বলেন, আমি আগে বেকার ছিলাম। গ্রামে ফেরি করে সংসার চালাতাম তখন চুল সংগ্রহ করে সৈয়দপুর বেহারিদের কাছে বিক্রি করতাম। তাদের কাছ থেকে সব কিছু শিখে আমিও শুরু করেছি চুলের কাজ। আমার কারখানায় ৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এই চুল কারখানায় চুলের সংকট ঠিক মত চুল পাওয়া যায় না। শ্রমিকদের অল্প মজুরি দিয়ে কাজ করার পরেও আমাদের পোষায় না। সরকার যদি আমাদের লোন ও বাহিদের দেশ থেকে চুল আমদানি করে দিতো তাহলে আমাদের মত ছোট চুল ব্যবসায়ীরা লাভবান হতো।

কারখানার মালিক ফজলুল ইসলাম বলেন, ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে মেয়েদের মাথার ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করি। তারা সেগুলো বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। আমরা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে এক কেজি চুল ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে কেনে। কারখানার নারী শ্রমিকদের দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ করি। সেই চুল ছোট বড় সাইজ অনুযায়ী ৬ হাজার থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত ১ কেজি চুল বিক্রি করি। তবুও আমাদের লাভ হয় না। কারখানায় ৩০ থেকে ৪০ জন শ্রমিক কাজ করে তাদের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করে দিতে হয়। আবার চুলের মিস্ত্রিদের মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়।

নারী উদ্যোক্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) লায়লা বানু বলেন, আমাদের উপজেলায় শাতাধিকের বেশি কারখানায় ১০ হাজারের বেশি নারী শ্রমিক চুলের কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি একবারে কম মাত্র ১০০ টাকা। এই সময় ১০০ টাকা মজুরি দিয়ে একটা মানুষের সংসার কীভাবে চলবে। কারখানাগুলোতে চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে লাভবান হচ্ছে কারখানার মালিকরা। কিন্তু নারী শ্রমিকরা সারাদিন কাজ করে কোনোরকম স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াই। অতি দ্রুত নারীদের মজুরি বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।

(ঢাকা পোস্ট)

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –