• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

একদিনে ৩১ খাসি জবাই করে বিক্রির রেকর্ড লক্ষ্মী রানির

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২২  

একপাশে লক্ষ্মী রানি শর্মা (৩৫) ফুলবাড়ী হাটে মাংস কেটে বিক্রি করছেন। অন্যপাশে ফুলবাড়ী হাট দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে ক্লাস করছে। লক্ষ্মী রানি শর্মা ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করানো, সংসার চালানোর জন্য বেছে নিয়েছেন কসাইয়ের মতো কঠিন পেশাকে।

শুরুতে শুনতে হয়েছে নানান কথা। পেশায় স্বাবলম্বী হয়েই জবাব দিয়েছেন সেসব কথার। ইচ্ছা থাকলে কঠিন কাজও জয় করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত লক্ষ্মী রানি শর্মা।

লক্ষ্মী রানি শর্মার মাংসের দোকান বিরল উপজেলার ৪ নম্বর শহরগ্রাম ইউনিয়নের ফুলবাড়ী হাটে। প্রায় ১০ বছর ধরে খাসির মাংস বিক্রি করেন তিনি। শুধু বিক্রি নয়, খাসি জবাই, চামড়া ছাড়ানো, মাংস কাটাসহ কসাইয়ের সব দ্বায়িত্ব পালন করেন তিনি নিজেই।

স্বামী ঊষা দেব শর্মা (৫৬) বিভিন্ন হাটে হাটে ঘুরে খাসি সংগ্রহ করেন। আর লক্ষ্মী রানি ভোর থেকেই তার দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি খাসির মাংস বিক্রি করেন। তবে হাটবারে (রবি ও বুধবার) বিক্রি হয় বেশি।

বুধবার সকালে ফুলবাড়ী হাটে কথা হয় লক্ষ্মী রানি শর্মার সঙ্গে।

লক্ষ্মী রানি শোনান এই পেশায় আসার গল্প। বাবার বাড়ী বোচাগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জ মাধবপুর গ্রামে। ৩ ভাই ৭ বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বিয়ে হয় ১৭ বছর আগে, সতিনের সংসারে। বিয়ের পর থেকেই স্বামীকে দেখেন ভবঘুরে জীবন কাটান। সংসারের প্রতি তেমন একটা নজর ছিল না তার। এরই মধ্যে লক্ষ্মী রানির কোলে আসে এক ছেলে সন্তান। সংসারে অভাব অনটন আরও বাড়ে। নিরুপায় হয়ে বাড়ির হাঁস-মুরগি, বিয়ের গয়না বিক্রি করে সাড়ে ৮ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ফুলবাড়ী হাটে দোকান ভাড়া নিয়ে খাসির মাংস বিক্রি শুরু করেন। প্রথমে তেমন বেচাকেনা না হলেও লক্ষ্মী রানি খাসির মাংস ব্যবসায়ী হিসেবে এখন বেশ জনপ্রিয়। একদিনে সর্বোচ্চ ৩১টি খাসি জবাই করে, বানিয়ে বিক্রি করার রেকর্ড রয়েছে তার।

তিনি বলেন, অনেকে অনেক কথা বলেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকেও বাধা দেওয়া হয়েছিল। কোনো কিছ্ইু কানে না তুলে ব্যবসা চালিয়ে গেছি। তখন যারা নিষেধ করেছিল তারাই এখন বলে লক্ষি রানী শর্মা সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল বলে তার পরিবার বেঁচে গেছে। ছেলে স্কুলে পড়ছে। মেয়ের বয়স চার বছর।

তিনি বলেন, গরিব মানুষ যদি ১০০ টাকার মাংস চায় সেটাও দিয়ে থাকি।

লক্ষ্মী রানি শর্মার স্বামী ঊষা শর্মা বলেন, শুধু স্থানীয়রা নন, দূর দূরান্ত থেকে সনাতন ধর্মের মানুষ মাংস কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তার দোকান থেকে। শুধু তাই নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য মাংস কিনতে আগে থেকেই সিরিয়াল দিতে হয় তাকে। এই ব্যবসা করে সংসার নিয়ে বেশ ভালোই আছেন তিনি।

বোচাগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা সুবল রায় বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্মী রানির দোকান থেকে মাংস ক্রয় করি। এখানে সঠিক পরিমাণ ও নিখুঁতভাবে কোনো প্রকার পানি ছাড়া মাংস কাটে। যেভাবে চাই, সেভাবেই তিনি মাংস বিক্রি করেন। এজন্য আমি শুধু নই, অত্র এলাকার সনাতন ধর্মের মানুষ সকাল থেকেই মাংস কিনতে লক্ষী রানির দোকানে ভিড় করেন।

লক্ষ্মী রানির মাংসের দোকানের কর্মচারী প্রাণ নাথ বলেন, আমরা দুজন কর্মচারী আছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা কাজ করি। শুক্র, সোম ও বুধবার প্রচুর ভিড় থাকে।

আরেক কর্মচারী ইসমাইল হোসেন বলেন, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য আমি নিজেই খাসি জবাই করে মাংস বিক্রি করে থাকি। তবে সনাতন ধর্মের মানুষই এই দোকানের ক্রেতা বেশি।

জানতে চাইলে স্থানীয় মেম্বার হামিদুল ইসলাম এবং মহিলা মেম্বার ইসমতারা বেগম বলেন, আমরা ৮/১০ বছর ধরে দেখছি লক্ষ্মী রানি শর্মা এই হাটে খাসির মাংস বিক্রি করে আসছে। মহিলা মানুষ সাহস করে এ ব্যবসা চালিয়ে আসছে এজন্য আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা সব সময় তার সঙ্গে আছি।

শহরগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওয়াহেদ আলী জানান, খুব পরিষ্কার ও যত্ন সহকারে লক্ষ্মী রানি মাংস বিক্রি করে। ধীরে ধীরে সে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মহিলা কশাই এই অঞ্চলে বিরল। একজন মহিলা হয়ে সে পুরুষের থেকেও বেশি কাজ করতে পারে। তার একদিনে সর্বোচ্চ ৩১টি খাসির মাংস বিক্রির রেকর্ড রয়েছে।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –