• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে নতুন করে চেনাবে পাঁচ সমুদ্রবন্দর

প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২০  

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার এ দুই বন্দরের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি আরো তিনটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। বর্তমান দুই বন্দরের উন্নয়ন ও নতুন সমুদ্রবন্দরগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হলে দেশের অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে। এই বন্দরগুলো বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে নতুন করে চেনাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১. চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর: ১৮৮৭ সালে চালু হওয়া বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম। দেশের আমদানি-রফতানির ৯০ শতাংশ এই বন্দর ব্যবহার করেই হয়ে থাকে। ২০১৯ সালে এই বন্দরটি বিশ্বের ৬৪তম ব্যস্ত বন্দরের স্বীকৃতি পেয়েছে। ৯.৫ মিটার ড্রাফটের ছোট জাহাজ ভিড়তে পারে এই বন্দরে। ১০ হাজার টনের বেশি জাহাজ ভিড়ানোর ক্ষমতা নেই বন্দরটির। এজন্য মাদার ভেসেল এখানে ভিড়তে পারে না। তাই সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের এক্সটেনশন হিসেবে বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে।

সমুদ্রের মোহনায় জেগে উঠা চরে প্রায় ১২০০ একরের বেশি জমিতে এ টার্মিনাল নির্মাণ কাজ চলছে। এতে খরচ হবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এখানে বন্দর চ্যানেলের গভীরতা এমন হবে যাতে প্রায় ১৩ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে। ফলে বড় মাদার ভেসেল ভিড়তে আর অসুবিধা হবে না। ৫০০০ কন্টেইনারবাহী জাহাজ সহজেই ভিড়তে পারবে। সেইসঙ্গে আনলোড করার সময় কমে হবে ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা। গতি আসবে বন্দরের কার্যক্রমে। এখানে মোট তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। ১৫০০ মিটার বা ১.৫ কি.মি. এর মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, ১২২৫ মিটারের কন্টেইনার টার্মিনাল-১ এবং ৮৩০ মিটারের কন্টেইনার টার্মিনাল-২।

২. মোংলা সমুদ্র বন্দর: মোংলা দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। পদ্মার উপর কোন সেতু না থাকায় এই বন্দর এক প্রকার রাজধানী হতে বিচ্ছিন্ন। তবে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে এবং সরাসরি রেল সংযোগ নিয়ে চলমান প্রকল্প শেষ হলে এই বন্দর আরো সচল হবে। মোংলা বন্দরকে আধুনিকায়ন করার অংশ হিসেবেই রেল সংযোগ প্রকল্প এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সব থেকে বড় রেলসেতু রূপসা রেলসেতুর নির্মাণ কাজ অনেক এগিয়েছে। সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে এই বন্দর ব্যবহার করবে নেপাল, ভারত। তখন এই বন্দরের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।

৩. পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর: পটুয়াখালীর পায়রা নদীর মোহনায় রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা বন্দরের অবস্থান। দক্ষিণাঞ্চলের ঠিক মাঝ বরাবর পায়রা বন্দরের অবস্থান, সেক্ষেত্রে বন্দরকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন শক্তি সঞ্চার হবে সেটা সহজেই বোঝা যায়।

পায়রা বন্দরের প্রাথমিক, মধ্যম এবং চূড়ান্ত পর্বে এটি বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ বন্দর হয়ে উঠবে। প্রকল্পটি প্রায় ৭ হাজার একর জমির উপর। পায়রা বন্দরের প্রবেশ চ্যানেলে নদীর প্রশস্ততা প্রায় ৪ কিলোমিটার। আর বন্দর থেকে সমুদ্রের দিকে টানা ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ টার্মিনাল করা হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনালে মাত্র ১৫০০ কন্টেইনার রাখার ব্যবস্থা আছে। পায়রার ক্ষেত্রে টার্মিনালে প্রায় ৭৫০০০ কন্টেইনার রাখা যাবে। ১ লাখ বর্গ ফিটের ওয়ারহাউজের কাজ প্রাথমিকভাবেই শেষ করা হবে। গভীরতার বিচারে পায়রা বন্দরে প্রায় ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে। 

মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার জন্য এটিকে ঘিরে বিশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন করা সম্ভব হবে। বন্দরের মোট প্রকল্পকে ১৯টি ভাগে ভাগ করে কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রায় ১২ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ হবে। সেইসঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন হাব করা হচ্ছে। থাকছে এলএনজি টার্মিনাল।

এই বন্দরের চাহিদার প্রধান গ্রাহক হবে বন্দর ঘিরে গড়ে তোলা বিদ্যুৎ হাব এবং ১০,০০০ একরের অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেইসঙ্গে জাহাজ নির্মাণের জন্য আলাদা অঞ্চল সৃষ্টি করা হচ্ছে। পদ্মাসেতু চালু হলে এবং ঢাকা থেকে পায়রা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ শেষ হলে সহজেই স্বল্প সময়ে পণ্য ঢাকাসহ সারাদেশে পৌঁছানো সম্ভব হবে। সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য লেবুখালিতে পায়রা নদীর উপর সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে, যেটি কয়েক বছরের ভেতরেই ঢাকার সঙ্গে পায়রার সরাসরি সংযোগ ঘটাবে। পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি বৃদ্ধিতে এই বন্দর বড় রকমের ভূমিকা রাখবে। এরইমধ্যে পায়রাকে ঘিরে গড়ে উঠা কয়লা ভিত্তিক দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের নির্মাণ শেষ হয়েছে।

৪. মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর: বাংলাদেশের সব থেকে গভীরতম সমুদ্রবন্দর হচ্ছে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর। মহেশখালী দ্বীপের আয়তন প্রায় ১৪ বর্গকিলোমিটার। সেইসঙ্গে মাতারবাড়ি চ্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪.৫ কিমি। ভাটার সময় গভীরতা থাকে প্রায় ১৪ মিটার। আর জোয়ারের সময় প্রাকৃতিকভাবেই গভীরতা হয় প্রায় ১৮.৫ মিটার। যদি ড্রেজিং করা হয় তবে গভীরতা আরো বাড়ানো সম্ভব।

মাতারবাড়ি এর লোকেশন নির্ধারণ এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আর এসবের নিমিত্তে বন্দর নির্মাণ কাজ পেয়েছে জাপান। শুরু থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। খরচ ছিল ৩৬ হাজার কোটি টাকা যার মধ্যে জাপান অর্থায়ন করবে ২৯ হাজার কোটি টাকা। আপাতত প্রায় ৪৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করা হবে। কয়লা নামানোর জন্য বন্দর সুবিধা এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত।

মাতারবাড়ি বন্দরের কাজ শেষ হলে এই দ্বীপে ২৪০০০ একরের বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিশাল বিনিয়োগ আসবে। এরইমধ্যে চীন সেখানে ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। জাপান তাদের বিশাল বিনিয়োগ এখানে আনছে। এই বন্দরকে কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য রেল ও সড়ক সংযোগ ঘটানো হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্প কারখানা এবং দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুৎ হাবের জন্য কয়লা বহন এই বন্দরের প্রধান কাজ হবে। এছাড়া এলএনজি এবং অন্যান্য কার্গো বহনেও ব্যাবহার হবে এই বন্দর।

৫. মিরসরাই ইকোনমিক জোন সংলগ্ন প্রথম বেসরকারি সমুদ্রবন্দর: জাপানের জেডিয়াই, সজিত কর্পোরেশন এবং আমাদের দেশের এনার্জিপ্যাক জোটবদ্ধ হয়ে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে উপমহাদেশের সব থেকে বড় ইকোনমিক জোন মিরসরাই সংলগ্ন একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করবে। জাইকা এখানে ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করার জন্য রাজি হয়েছে। আইএফসি অর্থায়ন করবে ১০০ মিলিয়ন ডলার।

সারাবিশ্বে মিরসরাই ইকোনমিক জোনের মতো এত আকর্ষণীয় ইকোনমিক জোন খুব কম আছে। ৩০ হাজার একরের উপর উপমহাদেশের সব থেকে বড় ইকোনমিক জোনের সঙ্গেই মিশে আছে সমুদ্র। এই ইকোনমিক জোনের চাহিদা বিবেচনায় আরো ১৩,০০০ একর জমি যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেটি হলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের আয়তন হবে ৪৩,০০০ একর। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে এখান থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে। বিমান বন্দর খুব কাছেই। সেইসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরও খুব কাছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের উপর এই বিশাল অঞ্চলে গড়ে উঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাপ যেন না পড়ে সে কারণেই সজিত কর্পোরেশন এখানে একটি সমুদ্র বন্দর করবে,যেটার কাজ মূলত শুধু এখানে বিনিয়োগ করা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পণ্য আমদানি ও রফতানি করা। এর অর্থ দাঁড়ায় এই ইকোনমিক জোনের নিজস্ব একটি ডেডিকেটেড সমুদ্রবন্দর থাকবে। ৪০০০০ টনের মাদার ভেসেল ভিড়তে পারবে এখানে। যদিও বন্দরের আকার ছোট হবে তবুও এত বিশাল বিশাল জাহাজ ভিড়তে পারার সুবিধাযুক্ত ইকোনমিক জোন বিশ্বের কয়টি দেশে আছে?

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –