• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সম্প্রীতির ৫৩ বছর: বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে বিশ্বরেকর্ড ভারতের

প্রকাশিত: ১৮ জুলাই ২০২৩  

 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন ইতিহাস গড়ে তুলেছে ভারত ও বাংলাদেশ। উভয় দেশই নিজেদের দেশবাসীর উন্নয়নের স্বার্থে একগুচ্ছ সফল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে ভারত রেকর্ড সংখ্যক ভিসা দিয়েছে গত বছর। আরো বেশি ভিসা প্রদানের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে বাংলাদেশে। উভয় দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বুঝেছেন, আমরা একে অন্যের পরিপূরক।

প্রতিবেশীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সেতুমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করলে বাংলাদেশ এগোতে পারবে না। ভারতও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা তাই বলেছেন, প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে আরো ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ভারত। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, গত বছর দেড় কোটি বাংলাদেশিকে ভিসা দিয়ে ভারত নতুন রেকর্ড করেছে।

ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে সর্বদাই সচেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই উভয় দেশ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ।বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। পরবর্তীতেও সেই শক্তিই বাংলাদেশকে ভুল পথে চালিত করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। কিছু সময়ের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের দাপটের কারণে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা খারাপ হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশের বিপদে-আপদে ভারত পাশে থেকেছে। করোনা মহামারির সময়ও দিল্লি থেকে প্রচুর সহায়তা পেয়েছে ঢাকা। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের পাশাপাশি উভয় দেশই এখন অর্থনীতির উন্নয়নকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। বাড়ছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও। আরো বেশি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেও দুই দেশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।

অতি সম্প্রতি উপহার হিসাবে ভারত বাংলাদেশকে আরো ২০টি রেল ইঞ্জিন দিয়েছে। দেশের রেল চলাচল উন্নততর করতে ডিজেল চালিত ব্রডগেজ লাইনের এই ইঞ্জিন গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা থাকলেও ঢাকার অনুরোধে দিল্লি রেল ইঞ্জিন পৌঁছে দিতে কার্পণ্য করেনি। গত মে মাসে এই ইঞ্জিন হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এবং ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ভার্চুয়ালি উপস্থিত থেকে দুদেশের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। ভারতীয় রেলমন্ত্রী আশ্বাস দেন, আগামী দিনেও বাংলাদেশে রেলের অবকাঠামোর উন্নয়নে পাশে থাকবে ভারত। বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী এর জন্য ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশে রেলে যাত্রীর সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ট্রেনের চাহিদা। তাই ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। এর আগে ২০২০ সালেও ১০টি লোকোমেটিভ ডিজেল ইঞ্জিন উপহার হিসেবে দিয়েছিল ভারত। এবারের ইঞ্জিন হস্তান্তরের সময় বাংলাদেশের হয়ে রেলের কর্মকর্তা অসীম কুমার হালদার উপস্থিত ছিলেন দর্শনায়। তিনিও খুবই প্রশংসা করেন ভারতীয় রেল ইঞ্জিনের।

ভারত ও বাংলাদেশ আসলেই ভালো বন্ধু। তাই উভয় দেশই নিজেদের দেশবাসীর স্বার্থে সেই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। আলোচনার মাধ্যমে যাবতীয় সমস্যা সমাধানেও দিল্লি ও ঢাকার আন্তরিকতার অভাব নেই। তাই দ্বিপাক্ষিক বহু সমস্যার সমাধান হয়েছে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার হাত ধরে। সীমান্তে সন্ত্রাস যেমন কমেছে, তেমনি উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যেও আজ খুবই সুসম্পর্ক বিরাজ করছে। সমস্ত সমস্যার সমাধান নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে মিটিয়ে নিচ্ছে বিএসএফ ও বিজিবি।

ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। শুধু প্রতিবেশীই নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে চিরকাল বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত সবসময়ই পাশে থেকেছে। দুদেশের সম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরীক্ষিত প্রকৃত বন্ধুত্বের পর্যায়ে উন্নীত। তাই সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখলে বাংলাদেশ এক পাও এগোতে পারবে না। সম্প্রতি বাসরহাট-হিয়াকো-রামগড় সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ভার্চুয়াল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের এই নেতা দুদেশের উন্নয়নে এই বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করা কতটা জরুরি তার ব্যাখ্যাও দেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভারতকে বাংলাদেশের কতটা দরকার সে কথাও বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশে বেশি বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীদের খুঁজতে আমাদের বেশি দূর যেতে হবে না।’ আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি দুদেশের সীমান্ত সমস্যাও যে আলোচনার মাধ্যমে শেষ করা সম্ভব হয়েছে সেটাও মনে করিয়ে দেন তিনি। ওবায়েদুল কাদের বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে দুই দেশের সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে আলোচনার মাধ্যমে।’ এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার মতে, দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক চেষ্টাতেই আজ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বর্ণযুগ চলছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, গত বছর দেড় কোটি বাংলাদেশিকে ভারতীয় ভিসা দিয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। দুনিয়ার কোনও দেশ অন্য দেশের নাগরিকদের এত ভিসা দেয় না। তার মতে, ভারত বাংলাদেশকে নিজেদের বন্ধু বলে মনে করে বলেই ভিসা পদ্ধতি এত সহজ-সরল করা হয়েছে। আরও বেশি ভিসাকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি নিয়েও কাজ চলছে বলে তিনি জানান। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের মতে, দুদেশের প্রধানমন্ত্রীদের আন্তরিক প্রচেষ্টাতে বহু সমস্যার সমাধান হয়েছে। আগামী দিনেও আলোচনার মাধ্যমে ঢাকা ও দিল্লি বহু বিষয়ে সহমতে পৌঁছাতে পারবে। সম্প্রতি গুলশানে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বৈঠকেও অংশ দেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। তিনি জানান, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও দুদেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হচ্ছে। দুদেশের অর্থনীতিই আজ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। গত পাঁচ বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বহর দ্বিগুণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী মোদির আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসছেন বলেও জানিয়েছেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত।

দু’দেশের শীর্ষ নেতৃত্বই চাইছেন নিজেদের দেশের সাধারণ মানুষদের উন্নতির স্বার্থে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের হাত ধরে অর্থনৈতিক বিকাশ। তাই বাণিজ্যের বহর বৃদ্ধির পাশাপাশি শিল্প স্থাপনেও উদ্যোগী হচ্ছে ভারত। ভারতের বিভিন্ন সংস্থা যাতে আরও বেশি করে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় সেই চেষ্টাও চলছে। দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ককে অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির কাজে লাগাতেও তৎপর উভয় দেশ।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দৃঢ় সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক আলোচনা রয়েছে। এই দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে যত গবেষণা ও বিশ্লেষণ হয়েছে তার ফলাফল হিসেবে সামনে এসেছে তিনটি বিষয়। আর তা হলো- আস্থা, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্য।

যেকোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাস শব্দ দুটি পরস্পর পরিপূরক। যেখানে আস্থা ও বিশ্বাস নেই সেখানে ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এই আস্থার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শুরু এই বাংলাদেশ থেকে এবং তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কলকাতা থেকে সারা ভারতজুড়ে চলেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। আর এ কারণেই তৎকালীন সময় থেকেই এই দুই অঞ্চলের মানুষ ব্রিটিশ শোষণ, অত্যাচার নিপীড়ন, আন্দোলনসহ অনেক কিছুই ভাগ করে নিয়েছে।

আস্থা, বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের এই বন্ধুত্বের বন্ধনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারতের সেভেন সিস্টারস হিসেবে পরিচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে আম উপহার হিসেবে প্রদান করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কূটনৈতিক অঙ্গন থেকে এই ‘ম্যাঙ্গো ডিপ্লোম্যাসি’ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ‘আম’ সুনির্দিষ্ট ঋতুর ফল। এই আম প্রেরণ এই নিদর্শন বহন করে যে দুই দেশ তাদের মধ্যকার সকল আনন্দ ও কষ্টগুলো সর্বদা ভাগ করে নিতে চায়। এভাবেই দুই দেশ পরস্পরের হাত ধরে উন্নয়নের নতুন এক রেকর্ড স্থাপনের পথে এগিয়ে যাবে বলে আশা করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। 

লেখক: ফারাজী আজমল হোসেন
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –